স্মৃতিকথা- দুই
রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
- আবুল হোসেন খোকন
দুই.
বেশ দ্রুতই কল্পনাতীত ফল মিললো। প্রেসরিলিজে সভা-সমাবেশের সংবাদ পাঠাচ্ছিলাম সংগঠনের প্যাডে। ছাপা হচ্ছিল রাজশাহী থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক বার্তা'য়। এ কাজের ভেতর দিয়ে প্রেরক হিসেবে প্রাপকের কাছে একটা পরিচিতি এসে যায়। ফলে আর প্যাডে লিখে সংবাদ পাঠানোর দরকার হচ্ছিল না। সাদা কাগজে পাঠালেই ছাপা হচ্ছিল। অবশেষে সংগঠনের সংবাদ পাঠানোর পাশাপাশি অন্য সংবাদও পাঠানো শুরু করলাম। ছাপাও হতে লাগলো। তখন পাবনা প্রতিনিধি ছিলেন অধ্যাপক শিবজিত নাগ। তাঁরসঙ্গে আমার কোন পরিচয় বা জানাশোনা ছিল না। তাঁর সংবাদগুলো ছাপা হচ্ছিল ‘নিজস্ব সংবাদদাতা’ পরিচিতিতে, আমারগুলো ‘সংবাদদাতা’ হিসেবে।
ঠিক এরকম সময় আমাদের দলীয় সংবাদপত্র ‘দৈনিক গণকণ্ঠ’র
পুনঃপ্রকাশ ঘটলো। এর
অফিস ছিল রাজধানী ঢাকার টিপু সুলতান সড়কে। পত্রিকাটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন জাসদের দাদাখ্যাত সিরাজুল আলম খান। সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন জাসদ নেতা মির্জা সুলতান রাজা। আমি তখন সাংবাদিক হিসেবে দলের নিজস্ব সংবাদপত্রে যুক্ত হতে পারাকেই প্রাধান্য দিলাম। সে
অনুযায়ী কারও সঙ্গে লবিং না করেই সংবাদ পাঠানো শুরু করলাম। আর
তা ছাপাও হতে লাগলো। এভাবে শুরু হলো পাবনা থেকে প্রাথমিক সাংবাদিকতা।
অবশ্য দৈনিক বার্তায়ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ের উপর প্রবন্ধ এবং সাহিত্য বিষয়ে লেখা পাঠাতে থাকলাম। এগুলো বেশ গুরুত্বসহকারে ছাপা হতে লাগলো। এমনকি প্রবন্ধগুলো উপ-সম্পাদকীয় কলামে প্রকাশ হলো। আমাকে দেখলে বা বয়স জানলে বিভাগীয় সম্পাদকরা হয়তো এ
লেখা মোটেও ছাপতেন না। কারণ এতো ছোট বয়সের লেখাগুলো আমার- তা বিশ্বাসই করতে চাইতেন না। আমাকে না
জেনেই সম্পাদকরা আমার লেখা প্রকাশের জন্য নির্বাচিত করছিলেন, এর মানে হলো- লেখাগুলোর মান, ভারত্ব এবং গুরুত্ব ছিল যথাযথ। এ ঘটনায় আমার ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছিল, যা পরবর্তীতে কলাম লেখায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। আরেকটা বিষয়ও প্রমাণ হয়েছিল যে, মার্কসবাদী-লেনিনবাদী দীক্ষার শক্তি অনেক অনেক বড়।
সাংবাদিকতা শুরু হলো। কোন আইডি বা নিয়োগ-পরিচয়পত্র ছিল না। কিন্তু এটা না হলে সাংবাদিক হিসেবে বৈধতা থাকে না। আবার প্রেসক্লাবের সদস্যও হওয়া যায় না। প্রশ্নটা যখন এসে গেল তখন পরিচয়পত্র বা নিয়োগপত্র পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। গণকণ্ঠ থেকে এগুলো পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করলাম। পাঠানো খবরের সঙ্গে চিঠি লিখলাম। জানিয়ে রাখলাম কবে ঢাকায় যাবো।
তখন দ্রুত যোগাযোগের কোন মাধ্যম ছিল না। সবচেয়ে দ্রুতর একটা মাধ্যম ছিল টেলিগ্রাম। টরে-টক্কা সিস্টেমে এটা পাঠানো হতো। মেজেস লিখতে হতো ইংরেজিতে। ঢাকায় পৌছানোর পর ঘণ্টা দুই-তিনেকের মধ্যে অফিসে যেতো। আর একটা মাধ্যম ছিল টেলিফোন। এর জন্য টেলিফোন অফিসে যেতে হতো। কল
বুক করতে হতো। তারপর লাইন পাওয়ার জন্য অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বসে থাকতে হতো। কখনও কখনও সারাদিনও লেগে যেতো। বড়
কথা হলো টেলিফোনে মোটা টাকা খরচ হতো। এসব কারণে প্রথম প্রথম এ
দুই মাধ্যমে সংবাদ পাঠাতাম না। পাঠাতাম খামে ভরে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে। পাঁচ পয়সা দিয়ে নয়/চার মাপের একটা খাম কিনতাম। সংবাদ লিখতাম। তারপর খামে ভরে মুখ না
লাগিয়ে উপরে লিখে দিতাম
‘প্রেস ম্যাটার/খোলা ডাক’। ব্যস তিন/চারদিনের মধ্যে খাম ঢাকার অফিসে পৌছে যেতো।
নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা গেলাম। ‘গণকণ্ঠ ভবন’ খুঁজে বের করলাম। চারতলা ভবন। যখন গেলাম তখন বিকেল। সংবাদপত্র অফিসে কাজ শুরুর সময়। নিচতলায় প্রেস এবং উপর তলাগুলোতে কম্পোজ-বার্তা বিভাগ এবং সম্পাদকদের রুম। আমি সরাসরি মফঃস্বল সম্পাদকের কাছে চলে গেলাম। তাঁর নাম সাইফুল আলম বাবুল। তিনিও অল্প বয়সী। আমি অবশ্য একাধিক কাপড়-চোপড় পরে নিজেকে ভারিক্কি এবং মোটা বানানোর চেষ্টা করে হাজির হয়েছিলাম। বাবুল ভাই বেশ আন্তরিকভাবে সব জেনে-শুনে আমার আইডি কার্ড প্রস্তুত করলেন। তারপর সম্পাদকের কাছে গিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে আনলেন। সবশেষে আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি নিজের প্রাণ ফিরে পেলাম। যখন সাংবাদিকতায় বৈধতা পেলাম তখন ১৯৭৯ সালের শেষার্ধ। আইডি কার্ডে আমার পদবী লেখা হয়েছিল ‘মফঃস্বল সংবাদদাতা, পাবনা’। এই হলো আমার আনুষ্ঠানিক সাংবাদিকতার শুরু।
------- চলবে -------
0 মন্তব্যসমূহ