স্মৃতিকথা- দশ
রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন
দশ.
আমি যখন উত্তরবার্তায় যোগদান করি তখন পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হচ্ছিল। সালটি ছিল ২ আগস্ট ১৯৯০। এদিন ইরাকী বাহিনী আকস্মিক কুয়েত দখল করে নেয়। যদিও পশ্চিমা দেশগুলো এই দখলকে আগ্রাসন বলে উল্লেখ করে, বাস্তবে এটি ছিল ইরাকের পশ্চিমাবিরোধী সামর্থ প্রতিষ্ঠার একটি যুদ্ধ। ইরাকী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন মনে করতেন, কুয়েত দখল করে দেশটির ভূগর্ভে থাকা বিপুল পরিমাণ তেলের মজুদ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে ইরাকই হয়ে উঠবে সর্বেসর্বা। কুয়েতি তেল ভান্ডারের মালিক হতে পারলে পুরো বিশ্বের মোট জ্বালানির ২০ ভাগই ইরাকের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। ইরাক পরিণত হবে খুবই শক্তিধর রাষ্ট্রে। যা হবে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের আধিপত্য রোখার জন্য সহায়ক। তবে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হয়তো ধারণা করেননি, এটা কখনই বাস্তবায়ন হতে দেবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্ররা। তারা মরিয়া হয়ে ইরাককে প্রতিহত করবে। ফল তাই-ই হয়েছে। ইরাকের কুয়েত দখলের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র ও ৩৪টি মিত্র দেশ মিলিতভাবে ইরাকের উপর সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে। শুরু হয় বিশ্ব কাঁপানো উপসাগর যুদ্ধ।
এ যুদ্ধ ছিল আমাদের দেশের সংবাদপত্রের জন্য বিরাট ব্যাপার। অর্থাৎ এই যুদ্ধকে ঘিরেই খুলে যায় কাগজের ভাগ্য। বেড়ে যায় কাটতি। বগুড়ায় দৈনিক উত্তরবার্তা খুব চমৎকারভাবে এই যুদ্ধকে লুফে নিয়েছিল। তখন উত্তরবার্তার সার্ক্যুলেশন ছিল হাজার পাঁচেকের মত। একই অবস্থা ছিল আরেক প্রভাবশালী দৈনিক করতোয়ারও। কিন্তু উপসাগর যুদ্ধ দৈনিক উত্তরবার্তার সার্ক্যুলেশন লাফিয়ে লাফিয়ে ১০ হাজার, ২০ হাজার, ৩০ হাজার, ৪০ হাজার, ৫০ হাজার, সবশেষে ৬০ হাজার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছিল। শুধু উত্তরবার্তা নয়, সম্পাদক মাহবুব উল আলম টোকন ভাই এই সুযোগে তাঁর পুরনো একটা সাপ্তাহিক পত্রিকাও পূনরুজ্জীবিত করে ফেলেন। সাপ্তাহিকটির নাম ‘শরণী’। এই সাপ্তাহিকের নির্বাহী সম্পাদক করা হয় আমাকে। সম্পাদক থাকেন টোকন ভাই। দুজনের নামই প্রিন্টার্স লাইনে ছাপা হতে লাগলো। প্রকশনা শুরু হতেই শরণীর সার্ক্যুলেশন প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ হাজারের মত হয়ে গেল।
এই সময়ের কাজগুলোর কথা খুব মনে পড়ে। আমাকে একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করতে হতো। উত্তরবার্তার প্রথম পাতা এবং পেছনের পাতার প্রায় সব সংবাদই সম্পাদনা করা, লীড নিউজসহ বড় হেডিংয়ের অনেকগুলো নিউজ লেখা, সপ্তাহে অন্তত তিনটি করে উপ-সম্পাদকীয় লেখা- এগুলো সবই ছিল আমার কাজ। টোকন ভাই এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুহম্মদ আবদুল মতীন কোন কারণে অফিসে আসতে না পারলে সম্পাদকীয়টাও আমাকে লিখতে হতো। পেজ মেকাপের কাজটিও বেশিরভাগ সময় আমাকেই করতে হতো। এটা গেল উত্তরবার্তার বিষয়। শরণীর জন্য গোটাটাই করতে হতো আমাকে। টোকন ভাই শুধু চূড়ান্তটা দেখে দিতেন। আবার তিনি ঢাকায় থাকলে আমাকেই পুরোটা দেখে দিতে হতো। সে যাই হোক- এই শরণীর চমক লাগানো হেডিং করা, সেই হেডিংয়ের অন্তত ১৫/২০টি প্রতিবেদন লেখা, এর সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখা ইত্যাদি সবই একা হাতে করতে হতো। আর দৈনিক এবং সপ্তাহিকে ইরাকের বিটটা ছিল পুরো আমার উপর। বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা, ডয়চে ভেলে, রেডিও মস্কো, রেডিও বেইজিং, আকাশবাণীসহ যতো রেডিও আছে- তার সবই আমাকে মনিটর করে প্রতিদিনের নিউজ লিখতে হতো। এক কথায় হাত, মাথা, শরীর, মন-প্রাণ সবকিছু মিলে ছিল শুধু লেখা আর লেখা। কী করে যে তখন এতোকিছু করেছি- তা আজ ভাবলে নিজেই অবাক হয়ে যাই।
ইরাকের
নিউজ লিখতে লিখতে এমন হয়ে গিয়েছিল যে, ইরাকের কোথায় কি আছে, কোন জায়গার কোন্ নাম, কোথায় কোন্ পথ, সাদ্দামের সহযোগী কে কে, সেনা বাহিনীর হাতে কি কি সমরাস্ত্র আছে, কোন সমরাস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয়- ইত্যাদি সবকিছু নখদর্পনে এসে গিয়েছিল। অর্থাৎ নিজে একটি ‘ইরাকী ব্যাংক’ বা রোবট হয়ে গিয়েছিলাম। শুধু ইরাক কেন- প্রতিপক্ষের বিষয়েও একই নখদর্পন অবস্থা ছিল।
এখানে একদিনের একটা ঘটনা বলি। রেডিও মনিটরের পর রাতে লিড নিউজ লিখছিলাম। এটা ছিল এইদিনে উপসাগর যুদ্ধের সর্বশেষ তথ্য সম্বলিত খবর। আমি যখন প্রতিবেদনটি লিখছি- ঠিক তখনই টোকন ভাইয়ের এক বন্ধু, যিনি সামরিক বাহিনীর একজন মেজর অথবা তারও উপরের পদের অফিসার, বগুড়া ক্যান্টনমেন্টে থাকেন- তিনি অন্যান্য দিনের মত অফিসে ঢুকেই নিউজ রুম দেখতে এলেন। এসে তিনি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমার লেখার দিকে তাকিয়ে রইলেন। আমি দ্রুত লিখে যাচ্ছিলাম- এদিন মার্কিন বহুজাতিক বাহিনী কোথায় কোথায় কিভাবে হামলা চালিয়েছে, কোথায় কোথায় বোমা ফেলেছে, কী কী সমরাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে, হামলায় কতোজন হতাহত এবং কি রকম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে- ইত্যাদি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম কোথায় কোথায় অবস্থান করে কি কি কথা বলেছেন, কিভাবে বহুজাতিক হামলার পাল্টা জবাব দিয়েছেন এবং এতে কতোজন মার্কিন সেনা হতাহত হয়েছে, বা বহুজাতিক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা হয়েছে- তা উল্লেখ করছিলাম। আন্তর্জাতিক নেতাদের নানা বক্তব্যও তুলে ধরছিলাম। লেখার সময় কাছে কোন রেডিও বা এমন কোন যন্ত্রপাতি ছিল না- যা থেকে শুনে শুনে লেখা যায়। সামরিক অফিসারটি ছিলেন ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে যুক্ত। তারা অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন। কিন্তু আমি কীভাবে কোন যন্ত্রপাতি ছাড়া দিব্বি উপসাগর যুদ্ধের খবর লিখে যাচ্ছি কম্পিউটারের মত- তা তিনি কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিলেন না। হা করে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি টোকন ভাইয়ের রুমে গিয়েই প্রশ্ন শুরু করেন, কীভাবে আমি এসব লিখছি এবং খবর পাচ্ছি। টোকন ভাইও জোক করার মত চুপ করে থেকে মিটি মিটি হাসছিলেন। হতভম্ব সেনা কর্মকর্তা ততোই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন। পরে টোকন ভাই তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেন, এগুলো রেডিও থেকে শুনে মাথায় রেখে লেখা তৈরি করতে হয়। সেনা অফিসার চলে যাবার পর হাসতে হাসতে টোকন ভাই বেরিয়ে এসে কথাগুলো জানিয়েছিলেন।
উপসাগর যুদ্ধ চলেছিল প্রায় পাঁচ মাস। পাঠকের চাহিদা বিবেচনা করে এরইমধ্যে উত্তরবার্তা সম্পাদক আরেকটি সাপ্তাহিকের ডিক্লারেশন বের করে ফেলেন। এটির ঠিকানা রাখা হয়েছিল ঢাকার। কিন্তু ছাপা শুরু করা হয় বগুড়া থেকে। সাপ্তাহিকটির নাম ‘পূর্বালোক’। এটিরও নির্বাহী সম্পাদক করা হয় আমাকে, সম্পাদক-প্রকাশক থাকেন টোকন ভাই। একদিক থেকে এটা সুখবর হলেও আমার জন্য বেশ কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। কারণ সাপ্তাহিক শরণীর ক্ষেত্রে আমাকে যে কাজগুলো করতে হচ্ছিল, এটার জন্য আমাকে সে কাজই করতে হলো। অর্থাৎ নিউজ বের করা, লেখা, সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখাসহ সব আমার কাজ। লিখে এতোগুলো পাতা ভর্তি করা সহজ করা নয়। একটা পত্রিকা হলে তাও হতো, তিন তিনটে পত্রিকা। একটা মানুষের জন্য যা সত্যিই অকল্পনীয় চাপ। তারপরেও কীভাবে যে দায়িত্ব পালন করে গেছি- তা ভেবে আজ শুধুই বিস্মিত হই।
তবে একটা কথা না বললেই নয় যে, এতো দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি শুধু সমৃদ্ধ আর সমৃদ্ধ হয়েছি। এজন্য টোকন ভাইকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই।
দৈনিক উত্তরবার্তার ধরণ ছিল অন্যান্য জাতীয় সংবাদপত্রের মতোই। কিন্তু শরণী আর পূর্বালোকের ধরণ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’ নামের যে সংবাদপত্রটি ছিল, এই দুই সাপ্তাহিকের ধরণ ছিল সেই রকম। চমকপ্রদ শিরোনাম এবং খবর ছিল এই সংবাদপত্রের প্রধান বিষয়। কিন্তু এক বগুড়ায় আর কতো চমকপ্রদ সংবাদ হতে পারে? অসম্ভব ব্যাপার। তাই এরসঙ্গে যুক্ত করে ফেলতে হয় আন্তর্জাতিকতাবাদকে। যেহেতু উপসাগর যুদ্ধ ছিলই, তারসঙ্গে যুক্ত করা হয় বিশ্বের অন্যান্য ঘটনাও। বলা যায় এরকম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বাংলাদেশে এটাই প্রথম। কারণ এই ধাঁচে কোন সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বের হয়নি কখনও।
আন্তর্জাতিকতাবাদ যুক্ত হওয়ায় চমকপ্রদ খবরের অভাব হয়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমার নীতি ছিল (এমনকি টোকনই ভাইয়েরও) কোন বানোয়াট, মিথ্যা, গসিপ নিউজ না লেখা। সুতরাং সত্যিকারের সংবাদ প্রকাশ করতে হলে নখদর্পনে রাখার বিষয় ছিল গোটা বিশ্বকে। যেহেতু আমাকেই সব করতে হতো, তাই আস্তে আস্তে হয়ে উঠি বিশ্ব সম্পর্কে সবজান্তা। কোন দেশের রাষ্ট্র প্রধান, সরকার প্রধান বা তাদের হর্তাকর্তারা, কিংবা সেনাপ্রধান, বিশ্ব কূটনীতিকরা কোথায় কি করছেন- তা আমার পক্ষে বলে দেওয়া ছিল মুহূর্তের ব্যাপার। এমনকি বিশ্ব কূটনীতি কোন পথে চলছে বা চলতে যাচ্ছে- তাও আমি বলে দিতে পারতাম। আমাকে যদি ওই সময় বিশ্বের যে কোন পরিস্থিতি বা যে কোন দেশ সম্পর্কে বলতে বলা হতো- তাহলে অনেক গবেষককেই হার মানতে হতো। এটা নিঃসন্দেহে একজন সাংবাদিকের জন্য বিশাল ব্যাপার ছিল।
এই আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কে জানার পেছনে ছোট বয়সের আরও কিছু ঘটনা আছে। তখন বাম রাজনীতি করতাম। শুধু করতাম বললে ভুল হবে- রীতিমত রাজনৈতিক প্রশিক্ষকের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই দেশ-বিদেশের অনেক কিছু জানা থাকতে হতো। কিন্তু সব জায়গায় মাতব্বরি করে এলেও ধরা খেয়ে যেতাম একজনের কাছে। সে হলো এক ভাগ্নে, ডাক নাম কচি। ও সেভেন-এইটে পড়াশুনা করতো রাজশাহী ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজে। ওর কাজ ছিলে খুঁটে খুঁটে বিভিন্ন সংবাদপত্রের আন্তর্জাতিক পাতা পড়া। এভাবে পড়তে গিয়ে ও আন্তর্জাতিক ঘটনা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিল। ফলে ওর সামনে যখন কোন আলোচনায় আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কথা বলতাম- তখন দেখতাম ও খুক খুক করে হাসছে। পরে এর কারণ জিজ্ঞাসা করতেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতো- কী কী ভুল-ভাল বলেছি। তখন লজ্জায় মরে যেতাম। সে কারণে আমি, পাঞ্জাব আলী বিশ্বাস (সাবেক সংসদ সদস্য), তোসলিম হাসান সুমন (পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক ভিপি), গোলাম মোস্তফা তারা (পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক জিএস) সহ সব ছাত্র নেতারাই ওর সামনে আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যেতাম না। তবে তলে তলে আমিও সংবাদপত্র পড়ে আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে আপডেট থাকার চেষ্টা করতাম।
------ চলবে ------
0 মন্তব্যসমূহ