স্মৃতিকথা : তেরো
রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন
তেরো.
কাজ শুরুর মধ্যদিয়ে বুঝলাম সংবাদের বাস্তবতা। ডেস্ক পড়ে আছে মান্ধাতার আমলে। সব লেখালেখির কাজ হয় হাতে লিখে। সম্পাদনাও হয় লেখা কপির উপর হাতের কলম চালিয়ে। এতেকরে সময় যেমন অনেক বেশি লাগে, ভুল সংশোধন করতেও কম্পিউটার কর্মীদের কষ্ট হয়। শুধু লেখা বা সম্পাদনাই নয়- সব কাজই হয় পুরনো নিয়মে। অর্থাৎ ডামি করা হয় কাগজের উপর হাতে এঁকে, মেকাপ কপি সাজানো হয় ট্রেসিং কেটে কেটে কস্টেপ সেঁটে। এরকম যতো কাজ- সবই মান্ধাতার আমলের। ডেস্কে কম্পিউটার আছে, কিন্তু সেটার ব্যবহার জানেন কম জনই।
শ্রদ্ধেয় বুলবুল ভাই যে
কম্পিউটার ব্যবহার করতেন এবং যে চোয়ারে বসতেন- সেটাতেই আমাকে কাজ করার জন্য বসানো হয়েছিল। আমি যেহেতু কম্পিউটারে কাজ করে অভ্যস্ত এবং কোন কপিই হাতে লিখিনা বা দেখি না,
সেহেতু প্রথমেই কাজটা শুরু করে দিয়েছিলাম আধুনিক নিয়মে। কম্পিউটারে লেখা, সম্পাদনা থেকে যাবতীয় কাজ যখন করতে লাগলাম এবং এতেকরে যখন দেখা গেল- সব কাজটাই হচ্ছে কল্পনাতীত দ্রুত গতিতে। একটা কপি হাতে সম্পাদনা করতে যেখানে আধাঘণ্টা লাগছে, সেখানে আমার কাছে তা
সম্পণœ হচ্ছে ৫/৭ মিনিটে। কোন লেখা হাতে লিখতে যেখানে এক-দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় লাগছে, সেখানে আমার লাগছে খুব বেশি হলে ১০
মিনিট। ফলে অফিসের সবাই এই ঘটনা দেখে নতুন করে ভাবনা শুরু করলেন। তারাও কম্পিউটার ব্যবহার শেখা শুরু করে দিলেন। এরপর দেখা গেল আমার উদ্যোগের কারণে অফিসের অর্ধেকের বেশিজন আস্তে আস্তে কম্পিউটার ব্যবহার শিখে সে-মত কাজ করা শুরু করেছেন। এমনকি পেজ মেকাপের কাজটিও শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারাইজড হয়ে যায়। বলা যায়, এতে করে সংবাদের সংবাদ বিভাগ মান্ধাতার আমল থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করলো। আমার উদ্যোগটা না থাকলে বোধহয় সংবাদকে এই জায়গায় পৌছাতে আরও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হতো।
আমাকে আরেকটা কাজ করতে বলা হয়েছিল। সেটা হলো- ন্যাশনাল ডেস্কের সার্কেলকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় নিয়ে আসা। ডেস্কের প্রধান হিসেবে আমার জন্য কাজ ছিল, গোটা দেশের প্রতিনিধিদেরকে কাজে-কর্মের জন্য ঢেলে সাজানো। কাজটা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সম্পণœ করে ফেলেছিলাম। প্রত্যেক জায়গার প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অবস্থা, সমস্যা এবং অন্যান্য বিষয় জেনে সেইমত যতোদূর সম্ভব ব্যবস্থা নিয়ে ফেললাম। আমি যেহেতু রাজনীতি-সংস্কৃতি এবং সংগঠনের সাংগঠনিক কাজ করা লোক- সেহেতু এগুলো ঠিক করা কঠিন কোন বিষয় ছিল না। এই কাজগুলো করতে গিয়ে সব জায়গার প্রতিনিধিদের সঙ্গে গভীর আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিল। তাঁদের সমস্যা, দুঃখ, দূর্দশা দূর করতে আমি হয়ে উঠেছিলাম মধ্যমনি। মুনীর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বিষয়গুলোর সমাধান টানছিলাম। কোথাও কোথাও কিছু অনিয়ম বা
কাজকর্ম সম্পর্কে অভিযোগ ছিল। সেইসব জায়গার প্রতিনিধি পরিবর্তন করে ভাল সাংবাদিককে নিয়োগ দিয়ে ন্যাশনাল ডেস্ক সার্কেলকে একটি সুসংগঠিত সার্কেলে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। অর্থাৎ নীচ থেকে উপর পর্যন্ত স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতিমুক্ত অবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল।
মুনীর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ডেস্কেও একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিলাম। আগে এই ডেস্কের কাজ শুরু হতো বিকেল থেকে। চলতো রাত ১০টা পর্যন্ত। এটার পরিবর্তন আনা হয়
এইভাবে যে- কাজ শুরু হবে সকাল থেকে এবং শেষ হবে বিকেলে। বিকেলের পর
কাজ শুরু করবে সেন্ট্রাল ডেস্ক। এরফলে আগে যেমন ন্যাশনাল ডেস্কের মেকাপ শেষ হতো রাত সাড়ে ১০টা, ১১টার দিকে, এখন সেটা শেষ হচ্ছে বিকেল ৫টার মধ্যে। রাতে কোন বড়
ঘটনা থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব সেন্ট্রাল ডেস্কের। এই ব্যবস্থাপনায় চলে আসায় কাজ যেমন দ্রুত এবং সময়মত শেষ হচ্ছিল, মূল কাগজ বের হতেও আর
ভোর ৪টা বাজার ব্যাপার থাকেনি। রাত ১টার মধ্যেই কাগজ প্রেস থেকে চলে যেতে থাকলো।
এরকম একটা ব্যবস্থাপনার কারণে ডেস্কের কাজেও যেমন সুন্দর একটা সিস্টেম ফিরে এসেছিল, ন্যাশনাল ডেস্কের নেটওয়ার্ক কর্মেও আমূল পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। প্রতিনিধিরা তাঁদের প্রতিবেদনগুলো দুপুরের আগেই দিয়ে দিতেন, আর তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনগুলো ৩টা-সাড়ে ৩টার মধ্যে দিয়ে দিচ্ছিলেন। পরের ঘটনাগুলো যাচ্ছিল সেন্ট্রাল ডেস্কের হাতে।
আমাকে ব্যবস্থাপনাটা এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে সমস্যায় যে পড়তে হয়নি, তা নয়। পড়তে হয়েছে। কারণ সব জায়গায়ই
Ôঅ-কাজের’ লোকদের অবস্থান ঠিক রাখতে Ôষড়যন্ত্রমূলক’ ভূমিকা থাকে। এটা যেমন সংসারে থাকে, সমাজে থাকে, রাষ্ট্রে থাকে- তেমন সংবাদেও ছিল। এই Ôঅ-কাজের লোকদের’ কাজ ছিল, সকাল সকাল অফিসে এসে মুনীর ভাইয়ের Ôকানভারী’ করা। তারা এটা করতেন, আর ধৈর্য ধরতেন। অপেক্ষা করতেন, মুনীর ভাই তাদের কথা রাখেন কিনা। কিন্তু মুনীর ভাই তাদের কথা শুনতেন, সেইমত কাজ করতেন খুব কম। যে কারণে আমার পক্ষে সামনে এগুনো সমস্যা হয়নি। তবে সমস্যাটা তৈরি হয়েছিল আরেক জায়গায়। সেটা পরবর্তীতে তুলে ধরবো।
এখানে একটা কথা না
বললেই নয় যে- ভাল কাজ চাইলে ভাল খাদ্যেরও যোগান দিতে হয়। কিন্তু এই
জায়গাটায় ছিল কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা বা
অনিচ্ছা। কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে ভাল কাজ চাইতেন, কিন্তু বেতন-ভাতার বেলায় থাকতেন উল্টো অবস্থানে। এটা কারও অজানা নয় যে, সংবাদে একজন সাব এডিটরকে যে
বেতন দেওয়া হয়,
তা ফুটপাতের ঝাড়ুদারের চেয়েও কয়েকগুন কম। আমাকে ২৭ হাজারের উপরে বেতন দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে তা পাইনি। নিয়োগপত্র দিতে চেয়ে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি। আমার বেতন দেওয়া হচ্ছিল ২৩
হাজার টাকা করে। আর আমার অধীনে থাকা সাব এডিটরদের দেওয়া হচ্ছিল ৫ হাজার টাকা করে। বেশিরভাগ প্রতিবেদকের বেতনও এই
৫ হাজার টাকা। তারপরে এই
বেতনও রাখা হয়
বকেয়া। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে মুনীর ভাইয়ের বেতন ৩৫ হাজার টাকা। তার আগে তিনি যখন সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেন, তখন বেতন ছিল আরও কম। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, মুনীর ভাইয়ের বেতন বকেয়া পড়েছে ১৫ বছরের মত। সাব এডিটর, রিপোর্টারদের বেতন বকেয়া কারও ৭
বছর, কারও ৫
বছর, কম করে হলেও কারও ২ বছর। সামান্য টাকা বেতন, তারপর তা বকেয়া! এই বাস্তবতায় Ôসুষ্ঠু’ এবং Ôদুর্নীতিমুক্ত’ ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ভাবনা কল্পনা মাত্র। তারপরেও সংবাদের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দুর্র্নীতির অভিযোগ ছিল না। খুব কষ্ট করে তারা Ôবাপের খেয়ে’ Ôমায়ের পয়সায়’ সেবা দিতেন সংবাদে। মফস্বলে যাঁরা করেন, তাঁদের তো পয়সা দেওয়া দূরে থাক- তাদের কাছ থেকেই সাহায্য-সহযোগিতা (বিশেষ করে শ্রম) নেওয়া হয় ভাল ভাল সাধু কথা বলে। অবশ্য বিজ্ঞাপন বিভাগ থেকে তাদেরকে বিজ্ঞাপনের জন্য কমিশন দেওয়ার কথা বলে কাজ আদায় করা হলেও, কমিশনের বেলায় নানা জটিলতা তৈরি করা হতো। সংবাদের মফস্বল সাংবাদিকরা এলাকায় প্রতিষ্ঠিত, অনেকেই বিত্তশালী ছিলেন বলে তাঁরা এ পাওনা নিয়ে উচ্চবাচ্য করতেন না। তাঁরা সাংবাদিকতা করে সমাজে উচ্চ সম্মান পান, এটাই ছিল তাঁদের বড়
পাওয়া। মফস্বল সাংবাদিকদের অবস্থার কথা আমি আমার একটি গ্রন্থে (এডিটিং এন্ড রিপোর্টিং) তুলেও ধরেছি।
কর্তৃপক্ষ বা মালিককে নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা চলমান ছিল। অভিযোগটা ছিল এইরকম যে, পরিবার থেকে বেতনের জন্য তাঁর হাত দিয়ে টাকা পাঠানো হয়েছে। মাঝ পথে তিনি আর সে টাকা অফিসে জমা দেননি। ওই টাকা নিয়ে তিনি ভারতে খেলা দেখতে চলে গেছেন। এদিকে বেতন না পেয়ে অফিসে যে কী করুণ দশা হতো- তা কল্পনাও করা যায় না।
প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ নির্ভর করতো প্রশাসনিক বিভাগের উপর। এই বিভাগের Ôনীতি’ নিয়ে সুনামের চেয়ে দুর্নামটাই বেশি। এই বিভাগের আবার প্রতিষ্ঠানের উপর একটা খবরদারি ভাব ছিল। এমনকি এ
বিভাগ বলা যায়, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককেও তোয়াক্কা করে না। মুনীর ভাই অনেক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে অফিস বয়কট পর্যন্ত করেছেন। কখনও ওই বিভাগের দায়িত্বশীলকে Ôচাকরি ছেড়ে দেওয়ার’ নির্দেশ দিয়ে লজ্জাস্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। উল্টো সেখান থেকে মুখের উপর বলে দেওয়া হয়েছে, Ôআমরা আপনার চাকরি করি না’।
মুনীর ভাই এসব পরিস্থিতিতে ভুগেও কাজ করেছেন। তিনি টেলিভিশনগুলোর টক শোতে অংশ নিয়ে নগদ যে
সম্মানীটা পেতেন- সেটাই ছিল তাঁর নিত্য খরচের মাধ্যম। টক শোগুলোতে মানুষের জন্য অনেক নীতিবাক্য শুনিয়ে নিজে তাঁকে নীতিবাক্য’র বাইরে জীবন চালাতে হতো।
---------- চলবে ----------
0 মন্তব্যসমূহ