রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন
এগারোআগেই বলেছি, আন্তর্জাতিক খবরকে ভিত্তি করে বগুড়ার মত মফস্বল শহর থেকে সংবাদপত্র বের করা ছিল বিরল ঘটনা। এটা বিরল আরও কতগুলো কারণে। তারমধ্যে একটি হলো এর পাঠকপ্রিয়তা এবং প্রচার। যেমন, সাপ্তাহিক শরণীর সার্কুলেশন উঠে গিয়েছিল প্রায় ৫০ হাজারে। আর সাপ্তাহিক পূর্বালোক-এর সার্কুলেশন ছিল ২০ হাজারের মত। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের পাঠকরা বিদেশি সংবাদ নির্ভর এই দুটি সংবাদপত্রকে প্রত্যাখান না করে উল্টোটা করেছেন। তারা বিদেশি সংবাদ ও ঘটনা প্রবাহের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তাঁদের জ্ঞানের ভান্ডারে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো। বিশ্বায়নের যুগে এটাকে কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখার ছিল না। আসলে সব মিলিয়ে সাংবাদিকতার দিক থেকে এটা ছিল সত্যিকারের সাফল্য। এই সাফল্যের জন্য যেমন সাপ্তাহিক দুটির সম্পাদক-প্রকাশক মাহবুব উল আলম টোকন ভাই ধন্য, তেমনই এরসঙ্গে যুক্ত থেকে এবং অবিরাম কাজ করে নিজেকেও ধন্য ও গর্বিত মনে করি।
সার্কুলেশনের বাইরে অরেকটি কথাও বলতে হয়। কারণ এ দিকটাকে বাদ রাখলে আসল বিষয়টিই চাপা পড়ে যায়। এই দিকটা হলো- দুটি সাপ্তাহিকেরই একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিল, লক্ষ্য ছিল। তা হলো- মানুষকে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-আগ্রাসনবাদ-সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতা-কুসংস্কারবিরোধী চেতনায় ধাবিত করা। তাঁদের গণতন্ত্র ও প্রগতিশীলতার লক্ষ্যে ধাবিত করা। এরকম লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করার পেছনে নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ছিল গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সম্পাদক মাহবুব উল আলম টোকন এক সময় বামপন্থী রাজনীতি করতেন। দীর্ঘদিন আন্ডারগ্রাউন্ডও থেকেছেন। তাঁর খালু, যিনি দৈনিক উত্তরবার্তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুহম্মদ আবদুল মতীন- তিনি ব্রিটিশ-ভারত কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা এবং সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন। আমাদের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। সব মিলে তিনি একজন কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন সাংবাদিকতার জীবনেও। দৈনিক উত্তরবার্তা, শরণী, পূর্বালোকের কাজ একই অফিস বা ঘর থেকে হতো বলে আমাদের একাত্মতা ছিল একাকার। নিজেও ওই রকম আদর্শের লোক। ফলে কাজ করায় কোন সমস্যা ছিল না। তবে এমন দর্শন ও লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে যে আমাদের পথ মসৃন ছিল, তা নয়। নানা বাধা-বিপত্তি এবং প্রতিবন্ধকতার মুখে তখন আমাদের সাংবাদিকতা করতে হয়েছে। কারণ দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র ছিল না। রাষ্ট্রীয়ভাবে ছিল না প্রগতিশীলতা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সে কারণে এসবের বিরুদ্ধে আমাদের রীতিমত লড়াই করতে হয়েছে।
বগুড়ায় অনেকদিন থেকেছি। সেই ১৯৯০ সালে গিয়েছি, তারপর কেটেছে ২০০৩ সাল পর্যন্ত। অর্থাৎ এক যুগ পার। কোথাও এক যুগ বাস করলেই নাকি সেখানকার নাগরিক, মানে সেটা জন্মভূমি হয়ে যায়। এই অর্থে বগুড়া আমার জন্মস্থান হয়ে গিয়েছিল। গিয়েছিল বলা ভুল। বগুড়া জন্মস্থান হয়ে গেছে, হয়ে আছে এবং থাকবে। এ কথাটা এজন্যই বলছি যে, বগুড়াকে এতোটাই ভালবেশে ফেলেছি, যাতে করে আমার প্রথম জন্মস্থান বেশ খানিকটা গৌনই হয়ে গেছে। এমন ভালবাসা জন্মে যাওয়ার কারণ বগুড়ার মানুষের ভালবাসা, সাংবাদিক বন্ধুদের ভালবাসা।
এক কথায় বলতে হয়, বগুড়ায় সাংবাদিক সহযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের সবসময় সব কাজে পেয়েছি- তাঁরা সবাই ছিলেন আদর্শ চিন্তার মানুষ, সৎ, নির্ভীক, প্রগতিশীল এবং সব ধরনের অন্যায়-অবিচার-অনিয়মের বিরোধী চেতনার। সে কারণে যাহেদুর রহমান যাদু, সমুদ্র হক, প্রদীপ ভট্টাচার্য শঙ্কর, আকতারুজ্জামান আকতার, মাহমুদুর রহমান মনা, রবিউল ইসলাম, মিলন রহমান, মাহমুদুল আলম নয়ন, আরিফ রেহমান, আমজাদ হোসেন মিণ্টু, আবুল কালাম আজাদ ঠান্ডা, শফিউল আযম কমল, চপল সাহা, রেজাউল হাসান রানু, আবদুল মোতালিব মানিক, কমলেশ মোহন্ত সানু, সাইফুল বারি ডাবলু, ফটো সাংবাদিক বিমু, বিনয় কুমার দাসসহ অনেককে কোনদিন ভুলবার নয়। তাঁরা এক একজন পথিকৃৎ সাংবাদিক। তাঁদের সততা, নিষ্ঠা এবং মহানুভবতার তুলনা হয় না।
বগুড়ায় সম্পাদক বা সংবাদপত্রের জগতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকজনের অবদান এবং কৃতিত্ব স্মরণীয়। দুর্গাদাস মুখার্জীর কথা আগেই বলেছি। মুহম্মদ আবদুল মতীন, মাহবুব উল আলমের কথাও বলেছি। এখানে উল্লেখ করতে হয় যে, বগুড়ায় পুরনো সংবাদপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, দৈনিক বাংলাদেশ। এর সম্পাদক আমান উল্লাহ খান শুধু প্রবীণ সাংবাদিক-সম্পাদকই নন, তিনি বরেণ্য রাজনীতিবিদও। ভাবগাম্ভিয্যের এই মানুষটি মানুষ হিসেবে খুবই অমায়িক। আমার সঙ্গে সবারই সুসম্পর্ক ছিল। তাঁর সঙ্গেও ছিল। তিনি বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা থেকে সামান্য এগিয়ে হাসপাতাল রোডের পাশে অফিস ঘর থেকে পত্রিকার দায়িত্ব পালন করতেন।
দৈনিক উত্তরবার্তা ছাড়াও আমি কাজ করেছি দৈনিক করতোয়ায়। এই দৈনিকটি এক পর্যায়ে স্থানীয় এবং জাতীয় সব সংবাদপত্রকে ছাড়িয়ে গোটা উত্তরাঞ্চলে এক চেটিয়া মার্কেট পেয়ে যায়। সার্কুলেশন লাখেরও অনেক উপরে চলে যায়। বগুড়া থেকে আধুনিক মেশিনে ছাপানো কালার্ড সংবাদপত্র এটিই প্রথম। এক পর্যায়ে এটি রাজধানীর বাজারেও অবস্থান গড়ে তোলে। অন্তত বছর তিনেকের মতো এই সংবাদপত্রে বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। তারপর ঢাকা চলে আসি। করতোয়া সম্পর্কে বলতে গেলে, প্রথমেই স্মরণ করতে হয় সংবাদপত্রটির প্রকাশক-সম্পাদক মোজাম্মেল হক লালু ভাইকে। তিনি কী অপরিসীম চেষ্টা, প্রজ্ঞা এবং আধুনিক চিন্তাধারায় তাঁর নেতৃত্বাধীন করতোয়াকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে অগ্রগতির পর অগ্রগতির পথে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকতার শীর্ষে উঠিয়েছেন- তা কল্পনাই করা যায় না। এই করতোয়া কিন্তু দেশের গোটা উত্তরাঞ্চলে ওই সময়ের 'ইত্তেফাক’ বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। এখন এর আরও প্রসার ঘটেছে। সুতরাং করতোয়াকে মফস্বল সংবাদপত্রের মাইলফলক বলা যায়। ব্যক্তিগতভাবে লালু ভাই অত্যন্ত সহজ, সরল এবং সমাজসেবী মানুষ। যদিও তিনি তাঁর সরলতার জন্য অনেক সময়ই বিভিন্ন রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন। কিছু মানুষ থাকে যারা কানকথা দিয়ে স্বার্থ হাসিল করে থাকে। লালু ভাই সরলতা এবং সহজ বিশ্বাসের কারণে এদের দ্বারা অনেক সময়ই বিভ্রান্ত হয়েছেন। তবে এ থেকে তিনি বেরিয়ে আসার প্রমাণও রেখেছেন বগুড়ায় আরও কতগুলো সংবাদপত্র জনপ্রিয় ছিল। এগুলো হলো মাকসুদার রহমান খুকু কর্তৃক প্রকাশিত দৈনিক চাঁদনী বাজার। সুপরিচিত মুকুল প্রেস থেকে এটি বের করা হতো। পুরনো সংবাদপত্রের মধ্যে আরেকটি হলো দৈনিক মুক্তবার্তা। এটি বগুড়ার বিশিষ্ট সাংবাদিক ওয়াসিকুর রহমান বেচান তাঁর সম্পাদনায় বের করতেন। যদিও বেচান ভাই বগুড়ার সংবাদপত্র জগতের অন্যতম শ্রষ্টা, কিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে তাঁকে অনেক সময়ই থমকে দাঁড়াতে হয়েছে। এ সময় বগুড়া থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় আরও তিনটি সংবাদপত্র হলো দৈনিক দুর্জয় বাংলা, দৈনিক আজ ও আগামীকাল এবং দৈনিক সাতমাথা। আমি বগুড়ায় থাকার সময় মূলত এগুলোই ছিল মূল সংবাদপত্র।
সাংবাদিকতা এবং রিপোটিং নিয়ে দুটো কথা বলতেই হয়। যেমন আমি পদবী অনুযায়ী সম্পাদকের অবস্থানে থাকলেও কার্যত রিপোর্টিংটা সব সময়ই ছিল। কারণ স্থানীয় এসব সংবাদপত্রের ধরণ ছিল, যিনি সম্পাদক বা সম্পাদনার বিভাগে দায়িত্ব পালন করেন, তাঁকে প্রেসরিলিজ লেখা-দেখা, রিপোর্টিং, এডিটিং, গেটআপ-মেকআপ সবকিছুই করতে হতো। অর্থাৎ একের মধ্যে থাকতে হতো সবকিছু। আমাদের সবারই সেটা ছিল। সুতরাং আমি রিপোর্টার জীবনের টুকিটাকি বলতে গিয়ে কাজ দেখালাম সম্পাদনায়- তা কিন্তু নয়। তাছাড়া আর্থিক সংকটের কারণে এক পর্যায়ে আমাকে বগুড়ার সংবাদপত্রে সম্পাদনা বিভাগে দায়িত্ব পালন করলেও শুধু রিপোর্টিংয়ের জন্য রাজধানীর সংবাদপত্রেও কাজ করতে হয়েছে। যেমন ওই সময় দৈনিক মাতৃভূমির উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। যদিও রিপোটিংয়ের পাশাপাশি এ সংবাদপত্রে বিশেষ কলামও লিখতে হয়েছে, যা ছাপা হয়েছে প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ মর্যাদা দিয়ে।
মাতৃভূমি সম্পর্কে একটি কথা না বললেই নয়। এরজন্য গভীর কৃতজ্ঞার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারকে। তিনি না থাকলে সম্ভবত আমার আর্থিক ভাগ্য সুসম্পন্ন হতো না। তিনি আমাকে বগুড়ায় থেকে গোটা উত্তরাঞ্চলের জন্য 'উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি’ হিসেবে শুধু নিযোগপত্রই দেননি, প্রতি মাসে সম্মানী বা বেতন হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন। বিভিন্ন ট্যুর এবং ছবিসহ অন্যান্য খরচের টাকা আলাদাভাবে দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছিলেন। বগুড়ার দৈনিক ও দুই সাপ্তাহিক মিলে তখন আমার বেতন ছিল তিন হাজারেরও নীচে। সেখানে এই পাঁচ হাজার টাকা যোগ হওয়া এবং এরসঙ্গে অন্যান্য খরচ মেলায় সত্যিই আমার ভাগ্য ফিরেছিল। বিভুদা যতোদিন ছিলেন ততোদিন এভাবেই টাকা পেয়েছি। তারপর তিনি যখন থাকতে পারলেন না তখন এটা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। অবশ্য এরপর বিভুদা একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেটিতেও তিনি লেখা বাবদ সম্মানী দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। তিনি যে কতোখানি সৎ, নির্লোভ, একনিষ্ঠ, আন্তরিক, উদার মনের মানুষ এবং বড় মাপের অভিজ্ঞ সাংবাদিক- তা তাঁর প্রতিটি কর্মে তখন বুঝতে পেরেছি। তিনিও অনেক দুঃসময় পার করেছেন, কিন্তু কখনও হার মানেননি।
সবশেষে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। সেটা হলো সৎ এবং সততার সাংবাদিকতার বিষয়। এটা বগুড়ায় পুরোদমে ছিল। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে এর বেশ খানিকটা ব্যত্যয় ঘটে। আর সেটার কারণ বগুড়ার সাংবাদিক বা সংবাদপত্র নয়। কারণ বাইরের একজন নীতিহীন সাংবাদিক। যাকে ঢাকা থেকে একটি সংবাদপত্রের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। নাম উল্লেখ করতে চাই না, তবে তাকে ঢাকায় অনেকে মদন বলে চেনেন। সেই মদন বগুড়ায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকতায় ধান্ধাবাজি এবং এ থেকে স্বার্থ হাসিলের উপায়গুলো অনেককে চিনিয়ে দেন। চেনানোদেরকে সেই পথে নামিয়ে দেন। এভাবে এ থেকে তিনি যেমন লাভবান হয়েছেন, তেমন ক্ষতি করেছেন বগুড়ার সাংবাদিকতাকে। কিন্তু সত্যিকারের সাংবাদিকদের জোড়ালো অবস্থান ছিল বা আছে বলেই বগুড়ার সাংবাদিকতা লড়াই করে সব সময় সঠিক পথে থাকতে পেরেছে। ---------- চলবে ----------