সোমবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৩

রিপোর্টারের টুকরো স্মৃতি- পাঁচ

 

 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

পাঁচ.

এদিকে পীরপুরের ঝড় নিয়ে আরেক কাÐ ঘটে গিয়েছিল ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি দেখে ছবি তোলার জন্য টাকা দিয়েছিলেন ইত্তেফাকের শ্রদ্ধেয় আনোয়ার ভাই (আনোয়ারুল হক) কথা ছিল ঘটনাস্থল থেকে ফিরেই ছবি প্রিন্ট করিয়ে তাঁকে দেবো কিন্তু আমিতো ফিরেই বগুড়া চলে গেছি প্রিন্ট করানোর সুযোগই পাইনি অবস্থায় আনোয়ার ভাই আমাকে আর খুঁজে পাননি ফলে তিনি তাঁর কাগজে ছবি পাঠাতে পারেননি ব্যর্থতার কারণে তাঁকে ডেস্ক থেকে দারুণ রকম বকা খেতে হয়েছিল

আমি বগুড়া থেকে ফিরেছিলাম রাতে তখন বন্ধ হয়ে গেছে ছবি প্রিন্টের স্টুডিও পাবনা নিউ মার্কেটে মিনার্ভা স্টুডিও নামে একটি জায়গা থেকে ছবি প্রিন্ট করাতাম স্টুডিওর মালিক অরুণ সরকার নিজে আমার কাজগুলো করে দিতো আনোয়ার ভাই স্টুডিও বন্ধ হওয়ার আগে কয়েক দফা সেখানে ঢু মেরেছেন, কিন্তু আমার কোন খবর পাননি কারণ আমি অরুনের সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারিনি সব মিলে পরের দিন আমাকে ছবি করে ভয়ঙ্কর লজ্জা আর অপরাধবোধ নিয়ে আনোয়ার ভাইকে সেগুলো দিতে হয়েছিল এসব কারণেই ঘটনাটি চীর স্মরণীয় হয়ে আছে শাসনামলের এই সময়গুলোতে সাংবাদিকদের আড্ডার জায়গা পাবনা প্রেসক্লাব ছাড়াও কয়েকটি জায়গায় ছিল এরমধ্যে একটা জায়গা হলো আবদুল হামিদ সড়কে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পাশে লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার এখানে কাজ না থাকলে সকাল বেলা থেকে দুপুর এবং বিকেলে বসতেন শ্রদ্ধেয় আনোয়ার ভাই (আনোয়ারুল হক), অধ্যাপক শিবজিত নাগ, কমিউনিস্ট নেতা প্রসাদ রায়, মির্জা শামসুল ইসলাম, আবদুস সাত্তার বাসু ভাই এবং এডভোকেট রণেশ মৈত্র এই আড্ডাটা ছিল নিয়মিত লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারের সঙ্গেই ছিল ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা ভাইয়ের বইয়ের দোকান সেখানে বসতেন তাঁর ছোট ভাই সংবাদের রবিউল ইসলাম রবি বসতেন আবদুল মতীন খানও পাশাপাশি বলে সবাই এদিক-ওদিক বসতেন আমারও এই জায়গাগুলোতে সংযোগ বেড়েছিল। আরেকটা বসার জায়গা ছিল অন্নদা গোবিন্দা পাবলিক লাইব্রেরি এই লাইব্র্রেরির সম্পাদক ছিলেন  শ্রদ্ধেয় মনোয়ার হোসেন জাহেদী স্যার তিনি সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব তাঁরসঙ্গে কাজ করতেন রবি ভাই এবং মতীন ভাই সে কারণে বিকেল-সন্ধ্যার দিকটাতে এখানেও আড্ডা হতো তাছাড়া জাহেদী স্যার ছিলেন বাংলার শিক্ষক হিসেবে সাহিত্য বিষয়ে পণ্ডিৎ ফলে সাংস্কৃতিক সাহিত্যের আড্ডা জমতো তাঁকে নিয়েই

আমি এসব জায়গায় কখনও নিয়মিত, কখনও অনিয়মিত যাতায়াত করতাম যেহেতু একেবারেই জুনিয়র ছিলাম, তাই নিজস্ব বসার জায়গা হিসেবে বেশি ব্যবহার করতাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের সামনে কাকলি বইঘরের সুশান্তর দোকানে এই দোকানে আমার সমবয়সীদের নিয়ে আড্ডা জমতো এতে যোগ দিতেন বিশেষ করে শুচি সৈয়দ, সমজিৎ পাল, মোস্তাফা আরব সতেজ, নাজিম উদ্দিন সরদার খোকা আড্ডাবাজদের মধ্যে শুচি সৈয়দ কিশোর বয়স থেকে কবি সাংবাদিক এখন দৈনিক যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক সমজিৎ পালও কবি, বিশেষ করে ছড়াকার এখন তিনি ডক্টরেট করে ঈশ্বরদী ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা সতেজ কিশোর বয়স থেকে কবি গল্পকার এখন তিনি পাবনা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকের নির্বাহী সম্পাদক নাজিম উদ্দিন খোকা দেশপ্রেমিক একজন খাঁটি মানুষ তিনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যাইহোক আমাদের বেশি অড্ডা ছিল কাকলি বইঘরে এছাড়াও শামীম আহমেদ বাবু নামে আমাদের একজন অতিপ্রিয় ছোট ভাই ছিল তার একটি হোসিয়ারি দোকান আছে আদমজী গলিতে খোকা ভাই এবং আমি এখানে অনেক সময়ই আড্ডা দিয়েছি। কাকলি বইঘরের মালিক সুশান্ত এবং মিনার্ভা স্টুডিওর মালিক অরুন সরকারকে নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন অরুন সরকার শিশু বয়স থেকেই নকশাল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল কারণে জেলে গেছে শিশু থেকে কিশোর বয়সে উঠতির সময় একই বয়স এবং ঘটনা আমারও তবে আমি নকশাল ছিলাম না ছিলাম জাসদে, গণবাহিনীতে আমিও জেলে, অরুনও জেলে বয়স কম বলে আমাদের রাখা হয়েছিলছোকরা ফাইলনামে কিশোরদের জেলকক্ষে পাশাপাশি থাকতে গিয়ে আলাপ-পরিচয়, এবং শেষে ঘনিষ্ঠতা হয় তারপর আমিও জেল থেকে মুক্তি পাই, অরুনও পায় আর আমাদের দেখা হয়নি তবে দেখা হলো, নিউ মার্কেটে মিনার্ভা স্টুডিও হওয়ার পর এই দেখাটা হয়েছিল আমারই বন্ধু নূর উজ জামান খোকনের বদৌলতে কী করে যেন খোকন মিনার্ভা স্টুডিওর সঙ্গে খাতির জমিয়ে অরুনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে সেই সুবাদে আমাকে একদিন সেখানে নিয়ে যায় এরপর অরুনকে পাই জানতে পারি, সে আর নকশাল রাজনীতির সঙ্গে নেই এখন ফটোগ্রাফির ব্যবসায় নেমেছে সাংবাদিক হিসেবে আমারও প্রয়োজন ছিল ফটোগ্রাফির কাজ করা স্টুডিও সেটা মিলে যায় এভাবেই। যে সুশান্তর কথা বলেছি, তিনি ছিলেন দারুণ ভাল মানুষ আমাদেরকে দোকানে বসিয়ে রেখে কোথায় যে লাপাত্তা হয়ে যেতেন, তার ঠিক ছিল না টাকা-পয়সার বাক্স, বেচা-কেনা ফেলে রেখে তিনি তার কাজে চলে যেতেন তিনি জানতেন আমরা থাকলে তার এক পয়সাও খোয়া যাবার ভয় নেই আমরাও সেটা মেনে নিয়ে দোকানে বসতাম দোকানদারীও করতাম বইপত্রের দোকান, খারাপ না তা ছাড়া বগুড়া থেকে প্রকাশিত যে দৈনিক উত্তরাঞ্চল, সেটার এজেন্সিও করে দিয়েছি সুশান্তকে

অরুন আর সুশান্তর কথা বলছি একটি কারণে তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ রাতারাতি কাউকে কিছু না জানিয়ে ভারতে পাড়ি দিচ্ছিলেন তারা যাবেন বা যাচ্ছেন- কথা কাক-পক্ষীকেও জানতে দিতেন না পাশের বাড়ির কেউ জানতেন না তারা চলে যাবেন সকাল বেলা উঠে তারা দেখতেন, ঘর-দুয়ার ফাঁকা কেউ নেই তার মানে বুঝে যেতেন- রাতের কোন এক সময় তারা সব ফেলে ভারতে চলে গেছেন  আমার এই দুইজনের ব্যপারেও তাই ঘটেছিল তবে তাদের যাবার কথা কেউ- জানতে না পারলেও, অরুনের ব্যাপার জানতাম আমি আর নূর উজ জামান খোকন অরুন আমাদের এতোটাই বিশ্বাস করতো যে, আমাদের কথাটা কদিন আগেই জানিয়ে রেখেছিল আর সুশান্ত জানিয়েছিল খোকা আর আমাকে একদিন আগের রাতে আমাদের দুজনকে ডেকে বিদায়ী ভোজও করিয়েছিল এজন্য এসব কারণেই তাদের দুজনকে ভুলতে পারিনি

 

------ চলবে ------