Story

রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন
 
এক.
রিপোর্টার হতে তখন প্রাতিষ্ঠানিক কোন ডিগ্রির দরকার হতো না  শুধু রিপোর্টার কেন
সম্পাদক হতেও ডিগ্রি লাগতো না তবে একটা যোগ্যতা লাগতোসেটা হলোবামপন্থী হওয়া বিশেষ করে মার্কসবাদ-লেনিনবাদে ভাল পড়াশুনা থাকতে হতো যোগ্যতাই প্রাতিষ্ঠানিক সর্বোচ্চ ডিগ্রিকে হার মানাতোআর বামপন্থী ক্যাডার হলে তো কথাই ছিল না
আমার যখন রিপোর্টারের আনুষ্ঠানিক হাতেখড়িতখন ১৯৭৯ সালদেশে ফ্যাসিবাদী শাসন সবে জেল থেকে বেরিয়েই  পথেতার ঠিক আগে বয়স কতোই-বাবড়জোড় ১৫পৈত্রিক বাড়ি ছিল পাবনা শহরের রাধানগর মহল্লায়
এই হাতেখড়ির একটা ইতিহাস ছিলস্কুলে যাচ্ছেতাই খারাপ ছাত্র হলেও গল্পের বই পড়ায় দারুণ ঝোঁক ছিলপারলে রাতদিন ডুবে থাকতাম এভাবে শিশু বয়সেই অসংখ্য বইপড়া হয়ে যায় বন্ধু-বান্ধব এবং স্কুল লাইব্রেরি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পাবলিক লাইব্রেরির বই পড়ে পড়ে অন্যরকম এডভেঞ্চারি এবং অনুসন্ধানী চরিত্র তৈরি হয়েছিলমনোজগতে এরসঙ্গে যোগ হয়েছিল বিজ্ঞান আর ইতিহাসভিত্তিক বইপত্রের শিক্ষাসবশেষে যোগ হয়েছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের দীক্ষা এবং বাম রাজনীতির ক্যাডার হিসেবে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকার অভিজ্ঞতা বলা যায় বালক বয়সেই ষোলকলা পূর্ণ
লেখালেখির অভ্যাসটা তখন থেকেই শুরুটা ছিল ডায়েরি দিয়ে তারপর চিঠিপত্রকবিতা লেখা ছবি আঁকা এমনকি গল্পের বই লেখার চেষ্টাও বাদ যায়নিরাজনৈতিক জগতে প্রবেশের পর এসব লেখালেখি খুব কাজে লেগেছিলকার্যক্রমের নোট লেখাএজেন্ডা লেখাপ্রচারপত্র লেখাসভার বিবরণী তৈরি করা ছিল প্রধান কাজ এক সময় প্রেসরিলিজ লেখার দায়িত্বটাও আমার উপর এসে যায়সেই থেকে ‘সংবাদ’ লেখার একটা ক্ষেত্র তৈরি হয়
আমার দারুণ আগ্রহ তৈরি হয়েছিলবিশেষ করে ঢাকা থেকে প্রকাশিত একটি পত্রিকায় (সাপ্তাহিক বিচিত্রা) ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ শিরোনামে সাংবাদিক ফয়েজ আহমদের ধারাবাহিক লেখা আমাকে এতোটাই অনুপ্রাণিত করেছিল যেএই পেশাটা আমার জন্য সবচেয়ে বড় চাওয়া-পাওয়ার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছিলসাংবাদিকতা যে কতোবড় সম্মানের পেশাআমার কাছে তার একটা উদাহরণ ছিল শহরের রূপকথা রোডের ঘটনা
ওই রোডে প্রায়ই / জনের একদল সাংবাদিক রাতের বেলা পায়চারি করার মতো হেঁটে হেঁটে গল্প করতেন যদিও জনসংখ্যা তখন একেবারেই কম ছিল রাস্তায় কোন ভিড় ছিল নাএরকম সময় সাংবাদিক দল যখন রাস্তায় নামতেন তখন দুপাশের দোকানপাট-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে একটা রাখঢাক পড়ে যেত বসে থাকা লোকজন চুপচাপ হয়ে যেতেনকেউ উচ্চস্বরে কথা বলতেন না কোন আলতু-ফালতু আচরণ করতেন নাসামরিক শাসনের সময়ের মতো সবকিছু ফিটফাটনির্ঝঞ্ঝাট হয়ে যেতআর লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতেন সাংবাদিকদের দিকেযেন তাঁরা সপ্তম আশ্চর্যের মানুষগুলোকে চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছেনআমিও ওভাবেই দেখতাম কেউ কেউ ইঙ্গিত করে বলতেন, ‘ওই যেওঁনারা কিন্তু সাংবাদিকসবাই সাবধান’ এটা কিন্তু ভয় পাওয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল নাসম্মানীদের সম্মান করতেইবা তাঁদের উপস্থিতিতে কোন বেয়াদবি হয়ে না যায়সেটা ঠিক রাখতেই  সাবধানতাযে / জন সাংবাদিক এভাবে হাঁটাচলা করতেন তাঁরা ছিলেন এডভোকেট রণেশ মৈত্রআনোয়ারুল হকমির্জা শামসুল ইসলামহাসনাতুজ্জামান হীরাআবদুস সাত্তার বাসুশিবজিত নাগরবিউল ইসলাম রবি  আবদুল মতিন খান
----- চলবে ----
 


 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

-       আবুল হোসেন খোকন

 

দুই.
বেশ দ্রুতই কল্পনাতীত ফল মিললো। প্রেসরিলিজে সভা-সমাবেশের সংবাদ পাঠাচ্ছিলাম সংগঠনের প্যাডে।ছাপা হচ্ছিল রাজশাহী থেকে প্রকাশিত জাতীয় দৈনিক বার্তা'য়। কাজের ভেতর দিয়ে প্রেরক হিসেবে প্রাপকের কাছে একটা পরিচিতি এসে যায়।ফলে আর প্যাডে লিখে সংবাদ পাঠানোর দরকার হচ্ছিল না।সাদা কাগজে পাঠালেই ছাপা হচ্ছিল।অবশেষে সংগঠনের সংবাদ পাঠানোর পাশাপাশি অন্য সংবাদও পাঠানো শুরু করলাম।ছাপাও হতে লাগলো। তখন পাবনা প্রতিনিধি ছিলেন অধ্যাপক শিবজিত নাগ।তাঁরসঙ্গে আমার কোন পরিচয় বা জানাশোনা ছিল না।তাঁর সংবাদগুলো ছাপা হচ্ছিল নিজস্ব সংবাদদাতা পরিচিতিতেআমারগুলো সংবাদদাতা হিসেবে।
ঠিক এরকম সময় আমাদের দলীয় সংবাদপত্র দৈনিক গণকণ্ঠ পুনঃপ্রকাশ ঘটলো।এর অফিস ছিল রাজধানী ঢাকার টিপু সুলতান সড়কে।পত্রিকাটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন জাসদের দাদাখ্যাত সিরাজুল আলম খান।সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলেন জাসদ নেতা মির্জা সুলতান রাজা।আমি তখন সাংবাদিক হিসেবে দলের নিজস্ব সংবাদপত্রে যুক্ত হতে পারাকেই প্রাধান্য দিলাম। সে অনুযায়ী কারও সঙ্গে লবিং না করেই সংবাদ পাঠানো শুরু করলাম।আর তা ছাপাও হতে লাগলো। এভাবে শুরু হলো পাবনা থেকে প্রাথমিক সাংবাদিকতা।
অবশ্য দৈনিক বার্তায়ও আর্থ-সামাজিক বিষয়ের উপর প্রবন্ধ এবং সাহিত্য বিষয়ে লেখা পাঠাতে থাকলাম।এগুলো বেশ গুরুত্বসহকারে ছাপা হতে লাগলো। এমনকি প্রবন্ধগুলো উপ-সম্পাদকীয় কলামে প্রকাশ হলো।আমাকে দেখলে বা বয়স জানলে বিভাগীয় সম্পাদকরা হয়তো  লেখা মোটেও ছাপতেননা। কারণ এতো ছোট বয়সের লেখাগুলো আমারতা বিশ্বাসই করতে চাইতেন না।আমাকে না জেনেই সম্পাদকরা আমার লেখা প্রকাশের জন্য নির্বাচিত করছিলেনএর মানে হলোলেখাগুলোর মানভারত্ব এবং গুরুত্ব ছিল যথাযথ। ঘটনায় আমার ভেতর এক ধরনের আত্মবিশ্বাস জন্ম নিচ্ছিলযা পরবর্তীতে কলাম লেখায় উদ্বুদ্ধ করেছিল। আরেকটা বিষয়ও প্রমাণ হয়েছিল যেমার্কসবাদী-লেনিনবাদী দীক্ষার শক্তি অনেক অনেক বড়।
 
সাংবাদিকতা শুরু হলো। কোন আইডি বা নিয়োগ-পরিচয়পত্র ছিল না।কিন্তু এটা না হলে সাংবাদিক হিসেবে বৈধতা থাকে না।আবার প্রেসক্লাবের সদস্যও হওয়া যায় না।প্রশ্নটা যখন এসে গেল তখন পরিচয়পত্র বা নিয়োগপত্র পাওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলাম। গণকণ্ঠ থেকে এগুলো পাওয়ার জন্য যোগাযোগ করলাম।পাঠানো খবরের সঙ্গে চিঠি লিখলাম। জানিয়ে রাখলাম কবে ঢাকায় যাবো।
তখন দ্রুত যোগাযোগের কোন মাধ্যম ছিল না।সবচেয়ে দ্রুতর একটা মাধ্যম ছিল টেলিগ্রাম। টরে-টক্কা সিস্টেমে এটা পাঠানো হতো।মেজেস লিখতে হতো ইংরেজিতে। ঢাকায় পৌছানোর পর ঘণ্টা দুই-তিনেকের মধ্যে অফিসে যেতো। আর একটা মাধ্যম ছিল টেলিফোন।এর জন্য টেলিফোন অফিসে যেতে হতো। কল বুক করতে হতো।তারপর লাইন পাওয়ার জন্য অনির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বসে থাকতে হতো।কখনও কখনও সারাদিনও লেগে যেতো।বড় কথা হলো টেলিফোনে মোটা টাকা খরচ হতো।এসব কারণে প্রথম প্রথম  দুই মাধ্যমে সংবাদ পাঠাতাম না।পাঠাতাম খামে ভরে পোস্ট অফিসের মাধ্যমে। পাঁচ পয়সা দিয়ে নয়/চার মাপের একটা খাম কিনতাম। সংবাদ লিখতাম।তারপর খামে ভরে মুখ না লাগিয়ে উপরে লিখে দিতাম প্রেস ম্যাটার/খোলা ডাকব্যস তিন/চারদিনের মধ্যে খাম ঢাকার অফিসে পৌছে যেতো।
 
নির্দিষ্ট দিনে ঢাকা গেলাম। গণকণ্ঠ ভবন খুঁজে বের করলাম। চারতলা ভবন।যখন গেলাম তখন বিকেল। সংবাদপত্র অফিসে কাজ শুরুর সময়।নিচতলায় প্রেস এবং উপর তলাগুলোতে কম্পোজ-বার্তা বিভাগ এবং সম্পাদকদের রুম।আমি সরাসরি মফঃস্বল সম্পাদকের কাছে চলে গেলাম। তাঁর নাম সাইফুল আলম বাবুল।তিনিও অল্প বয়সী। আমি অবশ্য একাধিক কাপড়-চোপড় পরে নিজেকে ভারিক্কি এবং মোটা বানানোর চেষ্টা করে হাজির হয়েছিলাম।বাবুল ভাই বেশ আন্তরিকভাবে সব জেনে-শুনে আমার আইডি কার্ড প্রস্তুত করলেন।তারপর সম্পাদকের কাছে গিয়ে স্বাক্ষর করিয়ে আনলেন।সবশেষে আমার হাতে তুলে দিলেন। আমি নিজের প্রাণ ফিরে পেলাম।যখন সাংবাদিকতায় বৈধতা পেলাম তখন ১৯৭৯ সালের শেষার্ধ।আইডি কার্ডে আমার পদবী লেখা হয়েছিল মফঃস্বল সংবাদদাতাপাবনাএই হলো আমার আনুষ্ঠানিক সাংবাদিকতার শুরু।
 
------- চলবে -------
 

রিপোর্টারের
টুকরো
স্মৃতি
আবুল হোসেন খোকন
 
তিন.
সাংবাদিকতায় নামলাম কিন্তু  সম্পর্কে কোন পড়াশুনা ছিল না।রাজনীতিতে থাকার কারণে রাষ্ট্রপররাষ্ট্রসমাজরাজনীতিঅর্থনীতিসাহিত্য-সংস্কৃতিইতিহাস ইত্যাদির উপর যে হাজারখানেক বইপত্র পড়াশুনা ছিলতা দিয়েই কাজ চালাচ্ছিলাম। কিন্তু সাংবাদিকতার বিধিবদ্ধ রীতি-নীতিসংবাদ লেখা বা গঠনের বিধানএসব জানা ছিল না। সময় পর্যন্ত জানতাম না যে লেখা সংবাদ-এর ইন্ট্রো কতো শব্দের মধ্যে হতে হবেসংবাদের গঠনপ্রণালী কিফিচার-প্রবন্ধ আর সংবাদ-এর মধ্যে পার্থক্য কোথায়।সাধারণ জ্ঞানে শুধু জানতাম অঘটনই সংবাদআর এটা লিখতে গেলে কে কি কেন কবে কোথায় কীভাবেএইসব প্রশ্নের উত্তরগুলো থাকতে হবে।আমি এটাই অনুসরণ করছিলাম।
শিখতে হয় পড়ে নয়তো করে আমি ছিলাম করে শেখার পর্যায়ে।অবশ্য করে শেখার উপরে কোন শেখা  যে নেইসেটা আজও বুঝি।একজন পড়ে পড়ে যতোই শিখুন না কেনকাজ করতে গেলে তিনি মোটেও পারবেন না। কিন্তু কাজ করে করে শেখা একজন তা পারবেন সুন্দরভাবে।
 
কাজ শুরু করলাম। প্রতিদিন একটা-দুইটা করে সংবাদ পাঠাচ্ছিলাম।ছাপা হচ্ছিল চমৎকারভাবে। লেখার মধ্যে গুণগত মানও বাড়ছিল।যতো কাজ করছিলাম ততো শিখছিলাম।ফলে Practical কাজের ভেতর দিয়ে গড়ে উঠছিল অনুসন্ধানী দৃষ্টিভঙ্গিতাছাড়া নিজের মধ্যে সব সময়ই একটা লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিলসেটা হলো লেখার ভেতর দিয়ে মুক্তিকামী বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষা করতে হবে। শ্রেণী-বৈষম্যের সমাজে এটাই সাংবাদিকতার আসল কথা বলে বিশ্বাস করতাম।ফলে নানা অঘটনের পাশাপাশি শোষণ-বঞ্চনা-লুণ্ঠন-নির্যাতন-দমন-পীড়ন এবং গণবিরোধী ঘটনার বিষয়গুলোকে তুলে ধরার চেষ্টা করছিলাম। একটি সুন্দর-সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার ক্ষেত্র তৈরির দিকে নজর রাখছিলাম।আসলে যে উদ্দেশ্যে রাজনীতিতে নেমেছিলামসেই উদ্দেশ্যটাকে লেখনীর ভেতর দিয়ে বিকশিত করতে চাইছিলাম। এমনিতে আর কিছু চাওয়া-পাওয়ার ছিল না।এই কাজ করে অর্থ উপার্জন করতে হবেএমন বাসনা কখনই ছিল না।মানুষের ভালবাসা পাওয়ার একটা বিষয় ছিল।সেটা অবশ্যই মানুষের জন্য সত্যিকারের কাজ করার ভেতর দিয়ে চেয়েছিলাম।
 
তখন লেখা লিখতাম খুবই যত্ন করে। কোন কাটাকাটি বা ভুল থাকতে দিতাম না।প্রয়োজনে কাগজ ছিঁড়ে ফেলে নতুন করে লিখতাম।দীর্ঘ সময় ব্যয় করতাম একটা লেখা লিখতে।এমনিতে তখন হাতের লেখাও ছিল খুবই চমৎকার।গোটা গোটা অক্ষরে পরিস্কার পাতায় লিখে খামে ভরে পোস্ট করে আসতাম।এতেকরে পত্রিকায় আমার লেখা এতোটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল যেবার্তা বিভাগকে একটা অক্ষরও কাটতে হতো না।আর খবরগুলো ছাপা হচ্ছিল বেশ বড় বড় হেডিংয়ে গুরুত্বসহকারে।
এই লেখার ভেতর দিয়ে দৈনিক গণকণ্ঠে আমার পদবী মফঃস্বল সংবাদদতা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতাপাবনা হলো। তারপর হলো পাবনা জেলা প্রতিনিধিএক পর্যায়ে গোটা উত্তরবঙ্গের সংবাদও লিখতে লাগলাম।এরমধ্যে একদিন দলীয় সফরে পাবনা এসেছিলেন সম্পাদক মির্জা সুলতান রাজা।বনমালী ইনস্টিটিউটের ভরা সমাবেশে তিনি আমার সম্পর্কে বলেছিলেনদৈনিক গণকণ্ঠে দেশের মধ্যে যে তিন/চারজন সবচেয়ে ভাল সাংবাদিকতা করছেনতারমধ্যে আমিও একজন।
 
আমাকে পাবনা প্রেসক্লাবের সদস্য করে নেওয়া হয়েছিল।ছোট হওয়ার কারণে ক্লাবের সবাই আমাকে খুব ভালবাসছিলেন।এইসঙ্গে খ্যাতিমান সাংবাদিকদের সঙ্গে মিশতে মিশতে সাংবাদিকতার খুঁটিনাটিও শিখে ফেলছিলাম।বিশেষ করে অধ্যাপক শিবজিত নাগএডভোকেট রণেশ মৈত্রআনোয়ারুল হকমির্জা শামসুল ইসলামআবদুস সাত্তার বাসুরবিউল ইসলাম রবিআবদুল মতীন খানের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ।
 
আমাদের সাংবাদিকতা চলছিল খুব আনন্দময় ভাবে।আমরা কয়েকজন একসঙ্গে দল ধরে বিভিন্ন অফিস-প্রতিষ্ঠানে যেতাম। সেখানে কাজ-কর্মের তথ্য নিতাম। কোন অভিযোগ থাকলে তা ক্রসকানেকশন করে যাচাই করতাম।তারপর পত্রিকা অফিসে পাঠিয়ে দিতাম। সেগুলো ছাপা হচ্ছিল বেশ গুরুত্বসহকারে।এইদিক থেকে আমার গণকণ্ঠরবি ভাইয়ের সংবাদমতীন ভাইয়ে কিষাণ এবং পরে বাংলার বাণী সবচেয়ে প্রাধান্য পাচ্ছিল।কারণ এই সংবাদপত্রগুলো তখন আমাদের স্টাইলে পাঠানো প্রতিবেদনগুলোকে পছন্দ করছিল। আমরা যে শুধু দল বেধে সাংবাদিকতা করতামতাই- নয়।আমরা পত্রিকার পলিসি অনুযায়ী আলাদা আলাদাভাবে প্রতিবেদনও লিখছিলাম।বিশেষ করে সিনিয়র সাংবাদিকদের এটা বেশি করতে হতো।কারণ দৈনিক বাংলাইত্তেফাকঅবজারভারটাইমস ইত্যাদি সংবাদপত্রগুলো ছোচ ছোট ঘটনার সংবাদগুলোকে গ্রহণ করতো।গণকণ্ঠ মতো বড় বড় আইটেম লেখার সুযোগ এগুলোতে ছিল কম।
 

--------- চলবে ----------


 

 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

 

চার.

রির্পোটিং ভালই চলছিল। তবে একটা পর্যায়ে এসে এটা দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল।অর্থাৎ নিউজ করতে করতে সম্পাদনার দায়িত্বও চেপে বসেছিল।এরই জের ধরে পরবর্তীতে সম্পাদক কাম রিপোর্টার হয়ে বছরের পর বছর কাজ করতে হয়েছে। সে বিষয়ে পরে আসছি।


খবর সংগ্রহ করছিলামলিখছিলামতারপর তা পত্রিকায় পাঠাচ্ছিলাম।আর পত্রিকায় সেগুলোই ছাপা হচ্ছিল। তখন এরশাদের সামরিক শাসনের সময়তাই রিপোর্ট ছাপা হওয়া মাত্র অ্যাকশন হচ্ছিল। এতেকরে নিজের মধ্যে একটা সাফল্যের ভাব ছিল। রিপোর্টের পাশাপাশি দৈনিক বার্তা ছাড়াও কিছু সাপ্তাহিকে প্রবন্ধ বা কলামও ছাপা হচ্ছিল। রকম পর্যায়ই শেষ পর্যন্ত আমাকে সম্পাদনা এবং কলাম লেখকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।

 

দৈনিক গণকণ্ঠকে ভিত্তি করে সাংবাদিকতা শুরু হলেও পত্রিকাটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সম্ভবত তখন ১৯৮৩ সাল। হঠাৎ করে গণকণ্ঠর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেল। আমি বেকার হয়ে গেলাম। গণকণ্ঠ আর বের হওয়ার অবস্থায় থাকলো না। স্বাভাবিকভাবেই রিপোর্টিংয়ে বাধা পড়লো। তখন দৈনিক বার্তায় সাহিত্য-সংস্কৃতি আর কলাম পাতায় লিখে সময় কাটাতে হচ্ছিল। কিন্তু রিপোর্টিংয়ের মানুষ আর কতোক্ষণই-বা রিপোর্টিং ছাড়া থাকতে পারেবাধ্য হয়ে অন্য জায়গায় যুক্ত হওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম।

তখন বগুড়া থেকে দৈনিক উত্তরাঞ্চল নামে একটি সংবাদপত্র বেরুতো। এটি ছিল ওই সময়ের দারুণ প্রভাবশালী দৈনিক। এর সম্পাদক ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য বাম রাজনীতিক দুর্গাদাস মুখার্জী। এই দুর্গাদাস মুখার্জী আর মুহম্মদ আবদুল মতিন ছিলেন স্বাধীনতা পূর্ব অবিভক্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক। দুজন সমপর্যায়ের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পরবর্তী সময়ে দুর্গাদাস মুখার্জী দৈনিক উত্তরাঞ্চল বের করেন। এই পত্রিকার লেখাগুলো আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং এটাতেই যুক্ত হওয়ার চিন্তা করলাম। তখনকার বাস্তবতায় নিউজ পাঠিয়ে যোগ্যতা প্রমাণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। সুতরাং আমি লেখা পাঠানো শুরু করলাম। আরকিছুদিন যেতে না যেতেই দেখলাম বেশ গুরুত্বসহকারে আমার নিউজ ছাপা হচ্ছে। যখন আরও কিছুদিন গেলএবং অনেকগুলো নিউজও বড় শিরোনাম করে ছাপা হলোতখনই সরাসরি যোগাযোগের উদ্যোগ নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সাড়াও পেলাম। অফিস থেকে আমাকে দেখা করতে বলা হলো। তার আগে অবশ্য আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিউজ টেলিফোনে পাঠিয়েছিলাম। অনেক নিউজের সঙ্গে ছবিও থাকছিল। সেই সুবাদে টেলিফোন বিল এবং আইডি কার্ড চেয়ে দুটো আবেদনও করে রেখেছিলাম।

 

এরইমধ্যে পাবনার পীরপুর চরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হলো। সময়টা ছিল ১৯৮৫ সালের ৩১ মার্চ। ঘূর্ণিঝড়ে বহু লোক মারা গিয়েছিল। গোটা পীরপুর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। ঝড় রাতে হয়েছিলসকাল বেলা হেলিকপ্টারে করে দেখতে এসেছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। আমরাও গিয়েছিলাম। নিউজ হিসেবে এটা ছিল সবচেয়ে বড় ঘটনা। ক্যামেরায় অনেক ছবি তুলে সেখান থেকে শহরে এসে বগুড়ায় টেলিফোন করে নিউজটি দিয়েছিলাম। সম্পাদক দুর্গাদাস মুখার্জী বললেনশুধু নিউজ দিলে হবে নাআমি যেন কালবিলম্ব না করে ছবি নিয়ে বগুড়া চলে আসি। আমার ছবিগুলো তখনও ক্যামেরায়। প্রিন্ট করিনি। প্রিন্ট করতে যথেষ্ট সময় লাগবে। আর তখন সরাসরি বগুড়ায় না গিয়ে ছবি পৌছানোর কোন উপায়ও ছিল না। সুতরাং পীরপুর চর থেকে শহরে টেলিফোনের কাজ সেরেই বগুড়ার বাসে উঠে পড়লাম। সকালে রওনা দিয়ে দুপুর নাগাদ বগুড়া পৌছলাম। অফিস খুঁজে বের করে সম্পাদককে ক্যামেরা দিয়েদিলাম। তিনি ছবিগুলো প্রিন্ট করানোর ব্যবস্থা করলেন।

 

প্রতিথযশা সাংবাদিক-রাজনীতিক দুর্গাদাস মুখার্জী অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের প্রভাবশালীরা তাঁকে খুব ভয় করতেন। কারণ তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। তাঁর অফিসের কর্মী থেকে শুরু করে সব সাংবাদিকরাও তাঁকে বাঘের মতো ভয় পেতেন। পরবর্তীতে আমি যেটা বুঝেছিলাম সেটা হলোতিনি ছিলেন বজ্র আটুনি আর ফস্কা গেড়ো মতো।

আমার ঘটনা দিয়েই বলি। আমি পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি-সম্পাদক সাক্ষরিত টেলিফোন বিল দাখিল করলাম। কারণ প্রেসক্লাব থেকে করা টেলিফোন কলের বিলগুলো একসঙ্গে আসতো। পরে যার যার কল অনুযায়ী বিল তৈরি করে দিতেন সভাপতি-সম্পাদক। কিন্তু দুর্গাদাস মুখার্জী সেটা মানলেন না। তিনি বললেনযার বিল তারটা টেলিফোন অফিস থেকেই দিতে হবে। অন্য কাওকে দিয়ে করা বিল বৈধ হবে না। তখন ভাবলাম তিনি হযতো টেলিফোন বিলযাতায়াত বিলফটোর বিলকিছুই দেবেন না। বেশ হতাশ হয়ে বসে রইলাম। তিনি উপরতলায় চলে গেলেন।

 

বগুড়ার কাটনার পাড়ায় দ্বিতল বাড়িটিই তাঁর অফিস এবং বাড়ি। আমি যখন খুব অসহায় বোধ করে পাবনা ফিরবো কিনা ভাবছিলামতখন উপরতলায় ডাক পড়লো। গেলাম। দেখি টেবিলের উপর অনেক রকম খাবার সাজানো। আমাকে সঙ্গে করে তিনি খাবেন। খেলাম। কথা বলতে বলতে পেটপুড়েই খেলাম। তিনি জবরদস্তি করে নানান রকম মিষ্টিও খাওয়ালেন। শেষে বিকাল বেলা বিদায়ের সময় তিনি একটা খাম তুলে দিলেন। যাতে ছিল টেলিফোন বিলছবির বিলসহ যাবতীয় খরচের টাকা এবং আইডি কার্ড।

আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। এতো বড় মাপের মানুষের কাছ থেকে এতো আন্তরিকতাএকাত্মতা আমার কল্পনায়ও ছিল না।

ওইদিনের খবরটা ছিল পরেরদিনের সব সংবাদপত্রের ব্যানার লিড নিউজ। আমার রিপোর্টও ব্যানার লিড হয়েছিল। সঙ্গে ছিল অনেকগুলো ছবি।

দৈনিক উত্তরাঞ্চল মানুষের মাঝে এতোটাই স্থান দখল করে নিয়েছিল যেবগুড়ার বাইরে পাবনায় এর অন্তত ৫০ কপি কাগজ চলছিল। কোনদিনও অবিক্রিত থাকেনি। ফলে চাহিদা কেবলই বেড়েছিল।

 

------------ চলবে -----------


 

 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

 

পাঁচ.

এদিকে পীরপুরের ঝড় নিয়ে আরেক কাРঘটে গিয়েছিল ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি দেখে ছবি তোলার জন্য টাকা দিয়েছিলেন ইত্তেফাকের শ্রদ্ধেয় আনোয়ার ভাই (আনোয়ারুল হক) কথা ছিল ঘটনাস্থল থেকে ফিরেই ছবি প্রিন্ট করিয়ে তাঁকে দেবো কিন্তু আমিতো ফিরেই বগুড়া চলে গেছি প্রিন্ট করানোর সুযোগই পাইনি  অবস্থায় আনোয়ার ভাই আমাকে আর খুঁজে পাননি ফলে তিনি তাঁর কাগজে ছবি পাঠাতে পারেননি  ব্যর্থতার কারণে তাঁকে ডেস্ক থেকে দারুণ রকম বকা খেতে হয়েছিল

আমি বগুড়া থেকে ফিরেছিলাম রাতে তখন বন্ধ হয়ে গেছে ছবি প্রিন্টের স্টুডিও পাবনা নিউ মার্কেটে মিনার্ভা স্টুডিও নামে একটি জায়গা থেকে ছবি প্রিন্ট করাতাম স্টুডিওর মালিক অরুণ সরকার নিজে আমার কাজগুলো করে দিতো আনোয়ার ভাই স্টুডিও বন্ধ হওয়ার আগে কয়েক দফা সেখানে ঢু মেরেছেনকিন্তু আমার কোন খবর পাননি কারণ আমি অরুনের সঙ্গে যোগাযোগই করতে পারিনি সব মিলে পরের দিন আমাকে ছবি করে ভয়ঙ্কর লজ্জা আর অপরাধবোধ নিয়ে আনোয়ার ভাইকে সেগুলো দিতে হয়েছিল এসব কারণেই ঘটনাটি চীর স্মরণীয় হয়ে আছে

 

সামরিক শাসনামলের এই সময়গুলোতে সাংবাদিকদের আড্ডার জায়গা পাবনা প্রেসক্লাব ছাড়াও কয়েকটি জায়গায় ছিল এরমধ্যে একটা জায়গা হলো আবদুল হামিদ সড়কে মুক্তিযোদ্ধা সংসদের পাশে লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডার এখানে কাজ না থাকলে সকাল বেলা থেকে দুপুর এবং বিকেলে বসতেন শ্রদ্ধেয় আনোয়ার ভাই (আনোয়ারুল হক), অধ্যাপক শিবজিত নাগকমিউনিস্ট নেতা প্রসাদ রায়মির্জা শামসুল ইসলামআবদুস সাত্তার বাসু ভাই এবং এডভোকেট রণেশ মৈত্র এই আড্ডাটা ছিল নিয়মিত লক্ষ্মী মিষ্টান্ন ভান্ডারের সঙ্গেই ছিল ন্যাপ নেতা আমিনুল ইসলাম বাদশা ভাইয়ের বইয়ের দোকান সেখানে বসতেন তাঁর ছোট ভাই সংবাদের রবিউল ইসলাম রবি বসতেন আবদুল মতীন খানও পাশাপাশি বলে সবাই এদিক-ওদিক বসতেন আমারও এই জায়গাগুলোতে সংযোগ বেড়েছিল

আরেকটা বসার জায়গা ছিল অন্নদা গোবিন্দা পাবলিক লাইব্রেরি এই লাইব্র্রেরির সম্পাদক ছিলেন  শ্রদ্ধেয় মনোয়ার হোসেন জাহেদী স্যার তিনি সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব তাঁরসঙ্গে কাজ করতেন রবি ভাই এবং মতীন ভাই সে কারণে বিকেল-সন্ধ্যার দিকটাতে এখানেও আড্ডা হতো তাছাড়া জাহেদী স্যার ছিলেন বাংলার শিক্ষক হিসেবে সাহিত্য বিষয়ে পণ্ডিৎ ফলে সাংস্কৃতিক  সাহিত্যের আড্ডা জমতো তাঁকে নিয়েই

আমি এসব জায়গায় কখনও নিয়মিতকখনও অনিয়মিত যাতায়াত করতাম যেহেতু একেবারেই জুনিয়র ছিলামতাই নিজস্ব বসার জায়গা হিসেবে বেশি ব্যবহার করতাম ডায়াবেটিক হাসপাতালের সামনে কাকলি বইঘরের সুশান্তর দোকানে এই দোকানে আমার সমবয়সীদের নিয়ে আড্ডা জমতো এতে যোগ দিতেন বিশেষ করে শুচি সৈয়দসমজিৎ পালমোস্তাফা আরব সতেজনাজিম উদ্দিন সরদার খোকা আড্ডাবাজদের মধ্যে শুচি সৈয়দ কিশোর বয়স থেকে কবি  সাংবাদিক এখন দৈনিক যুগান্তরের সহকারী সম্পাদক সমজিৎ পালও কবিবিশেষ করে ছড়াকার এখন তিনি ডক্টরেট করে ঈশ্বরদী ইক্ষু গবেষণা কেন্দ্রের শীর্ষ কর্মকর্তা মোস্তফা সতেজ কিশোর বয়স থেকে কবি  গল্পকার এখন তিনি পাবনা থেকে প্রকাশিত একটি দৈনিকের নির্বাহী সম্পাদক নাজিম উদ্দিন খোকা দেশপ্রেমিক একজন খাঁটি মানুষ তিনি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত যাইহোক আমাদের বেশি অড্ডা ছিল কাকলি বইঘরে এছাড়াও শামীম আহমেদ বাবু নামে আমাদের একজন অতিপ্রিয় ছোট ভাই ছিল তার একটি হোসিয়ারি দোকান আছে আদমজী গলিতে খোকা ভাই এবং আমি এখানে অনেক সময়ই আড্ডা দিয়েছি

 

কাকলি বইঘরের মালিক সুশান্ত এবং মিনার্ভা স্টুডিওর মালিক অরুন সরকারকে নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন অরুন সরকার শিশু বয়স থেকেই নকশাল রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল  কারণে জেলে গেছে শিশু থেকে কিশোর বয়সে উঠতির সময় একই বয়স এবং ঘটনা আমারও তবে আমি নকশাল ছিলাম না ছিলাম জাসদেগণবাহিনীতে আমিও জেলেঅরুনও জেলে বয়স কম বলে আমাদের রাখা হয়েছিল ‘ছোকরা ফাইল’ নামে কিশোরদের জেলকক্ষে পাশাপাশি থাকতে গিয়ে আলাপ-পরিচয়এবং শেষে ঘনিষ্ঠতা হয় তারপর আমিও জেল থেকে মুক্তি পাইঅরুনও পায় আর আমাদের দেখা হয়নি তবে দেখা হলোনিউ মার্কেটে মিনার্ভা স্টুডিও হওয়ার পর এই দেখাটা হয়েছিল আমারই বন্ধু নূর উজ জামান খোকনের বদৌলতে কী করে যেন খোকন মিনার্ভা স্টুডিওর সঙ্গে খাতির জমিয়ে অরুনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলে সেই সুবাদে আমাকে একদিন সেখানে নিয়ে যায় এরপর অরুনকে পাই জানতে পারিসে আর নকশাল রাজনীতির সঙ্গে নেই এখন ফটোগ্রাফির ব্যবসায় নেমেছে সাংবাদিক হিসেবে আমারও প্রয়োজন ছিল ফটোগ্রাফির কাজ করা স্টুডিও সেটা মিলে যায় এভাবেই

যে সুশান্তর কথা বলেছিতিনি ছিলেন দারুণ ভাল মানুষ আমাদেরকে দোকানে বসিয়ে রেখে কোথায় যে লাপাত্তা হয়ে যেতেনতার ঠিক ছিল না টাকা-পয়সার বাক্সবেচা-কেনা ফেলে রেখে তিনি তার কাজে চলে যেতেন তিনি জানতেন আমরা থাকলে তার এক পয়সাও খোয়া যাবার ভয় নেই আমরাও সেটা মেনে নিয়ে দোকানে বসতাম দোকানদারীও করতাম বইপত্রের দোকানখারাপ না তা ছাড়া বগুড়া থেকে প্রকাশিত যে দৈনিক উত্তরাঞ্চলসেটার এজেন্সিও করে দিয়েছি সুশান্তকে

অরুন আর সুশান্তর কথা বলছি একটি কারণে তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ রাতারাতি কাউকে কিছু না জানিয়ে ভারতে পাড়ি দিচ্ছিলেন তারা যাবেন বা যাচ্ছেন কথা কাক-পক্ষীকেও জানতে দিতেন না পাশের বাড়ির কেউ জানতেন না তারা চলে যাবেন সকাল বেলা উঠে তারা দেখতেনঘর-দুয়ার ফাঁকা কেউ নেই তার মানে বুঝে যেতেনরাতের কোন এক সময় তারা সব ফেলে ভারতে চলে গেছেন  আমার এই দুইজনের ব্যপারেও তাই ঘটেছিল তবে তাদের যাবার কথা কেউ- জানতে না পারলেওঅরুনের ব্যাপার জানতাম আমি আর নূর উজ জামান খোকন অরুন আমাদের এতোটাই বিশ্বাস করতো যেআমাদের  কথাটা কদিন আগেই জানিয়ে রেখেছিল আর সুশান্ত জানিয়েছিল খোকা আর আমাকে একদিন আগের রাতে আমাদের দুজনকে ডেকে বিদায়ী ভোজও করিয়েছিল এজন্য এসব কারণেই তাদের দুজনকে ভুলতে পারিনি

 

------ চলবে ------


 

 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

 

ছয়.

এর বেশ আগে একটা কান্ড ঘটে যায় সন্ধ্যারাতে প্রেসক্লাবে যেতেই শিবজিত দা হঠাৎ ডেকে নিয়ে গেলেন ছাদের দিকে বললেনতিনি পাবনা থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক বিবৃতিতে যোগ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রকাশক ইয়াসিন আলী মৃধা রতন তাঁকে বার বার অনুরোধ করছেন সে কারণে তিনি তার অনুরোধে সাড়া দিতে চান  তাঁর নিজের সঙ্গে নিতে চান আমাকেও অর্থাৎ শিবজিত দা আর আমি নতুন হিসেবে সাপ্তাহিক বিবৃতিতে যোগ দেবো

বিবৃতি পত্রিকা পাবনার অত্যান্ত প্রভাবশালী সংবাদপত্র পাবনা থেকে এসময় দুটি সংবাদপত্রই বের হচ্ছিল একটি বিবৃতিআরেকটি সাবেক বামপন্থী নেতা শফিউর রহমান খানের সম্পাদিত সাপ্তাহিক পাবনা বার্তা এর প্রকাশকও শফিউর রহমান খান বিবৃতির সম্পাদক ছিলেন শফিকুল ইসলাম শিবলীসংক্ষেপ লেখা হতো শিবলী তিনি একাধারে কবিসাংবাদিক এবং আইনজীবী পরে জেনেছিলামকোন কারণে তাঁর সঙ্গে প্রকাশক রতন ভাইয়ের সম্পর্কের অবণতি ঘটে শিবলী ভাই পদত্যাগ করেন তখন রতন ভাই নতুন সম্পাদক খুঁজছিলেন তিনি শিবজিত দাকে সবচেয়ে উপযুক্ত মনে করেছেন এই ঘটনা থেকেই দাদাকে ওই দায়িত্ব গ্রহণের প্রস্তাব বা অনুরোধ জানানো হয় দাদা আমাকে সঙ্গে রাখার শর্তে এতে রাজী হন

দাদার প্রস্তাব আমি অত্যন্ত শ্রদ্ধা এবং কৃতজ্ঞতার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম তারপর একদিন আনুষ্ঠানিকতার মধ্যদিয়ে দাদা এবং আমি বিবৃতিতে যুক্ত হই শিবজিত দা শিক্ষকতায় সরকারি চাকরিতে ছিলেন বলে সম্পাদক হিসেবে তাঁর নাম প্রিন্টার্স লাইনে ব্যবহার করা সম্ভব ছিল না  অবস্থায় তিনি সম্পাদক থাকলেও প্রিন্টার্স লাইনে অবৈতনিক সম্পাদক পদবী ব্যবহার করেন এতেকরে সরকারি চাকরি করে অন্য কোথায়ও লাভজনক চাকরি করার বিধান থেকে রক্ষা পাওয়ার একটা সুযোগ ছিল অবশ্য প্রতিপক্ষের কেউ কেউ এরপরেও হেনস্তা করতে ছাড়েনি যাইহোকআমার দায়িত্ব প্রথমে হয় নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে পরে এক ঘটনায় প্রকাশক আমার পদবী লিখেছিলেন বার্তা সম্পাদক হিসেবে শেষে এই পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বও আমাকে নিতে হয়েছিল

সে যাইহোকশুরু থেকেই এই পত্রিকার মূল ছিলেন প্রকাশক রতন ভাই এবং শিবলী ভাই ছাড়াও জাহাঙ্গীর আলম মুকুলশ্যামল দত্তআবু মুহাম্মদ রইসশুচি সৈয়দসমজিৎ পালমোস্তফা আরব সতেজসেলিনা খান শেলীশামসুল আলম বকুলমুকুল আহমেদজয়নাল আবেদীনঅমল কান্তি সরকারসহ অনেকে এঁরা সবাই ছিলেন পাবনায় কবিতা চর্চার সুপরিচিত সংগঠন কবিকণ্ঠ কর্ণধার এক কথায় কবিকণ্ঠ থেকেই জন্ম নেয় বিবৃতি দাদাসহ আমি যখন এখানে যুক্ত হলাম তখন পেয়েছি জাহাঙ্গীর আলম মুকুলশ্যামল দত্তশুচি সৈয়দসমজিৎ পালমুকুল আহমেদকামাল আহমেদজয়নাল আবেদীন এবং অমল কান্তি সরকারকে এরমধ্যে জাহাঙ্গীর আলম মুকুল এবং শ্যামল দত্ত ঢাকা চলে গেলেনসেখানেই তাঁরা দায়িত্ব পালন করতে থাকলেন রইলাম মাত্র শিবজিত দা এবং আমিসহশুচি সৈয়দসমজিৎ পালমুকুল আহমেদজয়নাল আবেদীন এবং অমল কান্তি সরকার

এখানে আরেকটা কথা বলতে হয় সেটা হলো বিবৃতি যেমন জন্ম নিয়েছিল কবিকণ্ঠের ঘর থেকেতেমনইভাবে বিবৃতির ঘর থেকে জন্ম নিয়েছিল পাবনার অত্যন্ত প্রভাবশালী প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন গণশিল্পী সংস্থা

 

বিবৃতি ছাপা এবং প্রকাশ হতো বেনিয়া পট্টির বাণী মূদ্রণ থেকে এই প্রেসের মালিকও ইয়াসিন আলী মৃধা রতন এই বাণী মূদ্রণ গড়েছিলেন রতন ভাইয়ের বাবা ইউসুফ আলী মৃধা তিনি পাবনার বিখ্যাত বাস মালিকই শুধু ছিলেন নাপ্রকাশনা এবং শিল্পকর্ম চিন্তার দিক থেকে ছিলেন অত্যন্ত গুণী মানুষ সে কারণে তাঁর ছেলে ইয়াসিন আলী মৃধা রতনও কবিতা সংগঠনপ্রকাশনা এবং শেষ পর্যন্ত বিবৃতির মতো একটি সংবাদপত্র প্রকাশের দিকে ঝুঁকেছিলেন

 

শিবজিত দা দায়িত্ব নেওয়ার পর পত্রিকার নতুন অফিস করা হয় ব্যাংক রোডের দোতলায় আগে বাণী মূদ্রণকেই অফিস হিসেবে ব্যবহার করা হতো নতুন অফিসটি দারুণভাবে জমে উঠেছিল তিনটা রুম ছিল একটা রুমে শিবজিত দা বসতেন আর একটিতে প্রতিবেদকরা বসতেন মাঝের রূমটা ছিল কম্পোজ এবং বিজ্ঞাপন সেকশন

আমাদের কাজের দিনগুলো ছিল অসাধারণ এখানে বলে রাখা দরকারআমরা কিন্তু কেউ বেতনভূক ছিলাম না স্বতঃপ্রণোদিত কর্মী ছিলাম আমরা সম্পাদক শিবজিত দাও বেতন পেতেন নাবা নিতেন না আমরা নিজের শ্রম দিয়ে কাজ করতাম বিনা পয়সায় টুকিটাকি খরচও নিজেদের থেকেই করা হতো প্রকাশক রতন ভাই শুধু অফিস সাজিয়ে-গুছিয়ে দিয়েছিলেন অবশ্য তাঁকে কাগজ-কালি  ছাপার খরচ ঠিকই বহন করতে হতো নিজেদের প্রেসে যেহেতু ছাপাসে কারণে এই খরচটা দৃশ্যত লাগতো না পত্রিকা বিক্রি করেআর বিজ্ঞাপন থেকে যা আয় হতোতা পত্রিকার আনুসঙ্গীক খরচেই লেগে যেতো উপরন্তু ভর্তূকি দিতে হতো রতন ভাইকে এখানে প্রশ্ন উঠতে পারেআমরাই-বা কেন বিনে পয়সায় কাজ করতামআর রতন ভাইই-বা কেন গাঁটের পয়সা খরচ করতে যেতেনএর একটাই জবাবআমরা একটা দর্শন নিয়ে চলতাম মানবসেবা এবং এরজন্য সাংবাদিকতা ছিল আমাদের দর্শন আর সে কারণেই আমরা এভাবে কাজ করতাম

আগে বলেছিআমাদের দিনগুলো ছিল অসাধারণ শিবজিত দা সরকারি চাকরির আগে-পড়ে এসে বসতেন বিবৃতিতে তিনি তখন তুখোর সাংবাদিক আর সম্পাদক হয়ে দেখিয়েছেন আরও মুন্সিয়ানা যা কিনা দেশের বড় বড় পত্রিকাপত্রিকার সম্পাদক এবং গুণী ব্যক্তিত্বরা নানাভাবে প্রকাশ করেছেন আর শুচি সৈয়দসমজিৎ পালমুকুল আহমেদজয়নাল আবেদীনঅমল কান্তি সরকার এবং আমার কাজ ছিল সকাল-বিকাল-রাতে জমিয়ে কাজ করা এটা করতে গিয়ে দারুণ আড্ডা জমতো শিবজিত দা থাকতেন এর মধ্যমনি প্রকাশক রতন ভাই ছিলেন সব কিছুতে উজার করা উৎসাহদাতা ঢাকা থেকে নানান বুদ্ধি-পরামর্শলেখা এবং বিজ্ঞাপন নিয়ে জাহাঙ্গীর আলম মুকুল  শ্যামল দত্ত হাজির হতেন প্রায়ই এই আড্ডাগুলোর কোন তুলনাই হয় না  আড্ডা কোন ধুম-ধারাক্কা আড্ডা বলতে যা বোঝায়তা ছিল না ছিল শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতিসাংবাদিকতাইতিহাসঐতিহ্য আর মানুষের নিত্যনৈমিত্তিক জীবন নির্ভর ঘটনা নিয়ে শিক্ষামূলক আড্ডা এর মধ্যদিয়েই চলতো লেখালেখি তৈরি হতো পরিকল্পনাদিকনির্দেনা এবং মাঠের কাজের ক্ষেত্র এইসবের মধ্যদিয়ে আমরা সাংবাদিকতায় হয়ে উঠছিলাম দক্ষ থেকে আরও দক্ষ

আড্ডার বাইরেও ছিল মজার মজার নানা কান্ডকারখানা বিবৃতি ছিল আমাদের বাড়িঘর তাই কোনদিন দেখা যেতোরাতে কাজ করতে করতে বাড়িতেই ফিরলো না কেউ কোন রকমে দোকান থেকে কিছু খেয়ে কাঠের চেয়ারগুলো জড়ো করে তার উপর ঘুমিয়ে পড়া হতো প্রচন্ড গরমের দিনে তো সমস্যার কমতি ছিল না কারণ সব ঘরে ফ্যান ছিল না আর ফ্যান থাকলেই-বা কিমশা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছেতারা জানেনএগুলো কতো শক্তিশালী দল দেখা যেতো জামা-কাপড় সব খুলে চেয়ারের উপর টানটান হয়ে এক-দুইজন ঘুমিয়ে পড়েছে আর তাদেরকে ঢেকে রেখেছে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ মশা মশা দিব্বি রক্ত খেয়ে শরীরেই পড়ে থাকতো বেচারা যারা বেহুঁশের মতো ঘুমাতেনতারা এগুলো খেয়ালই করতেন না সকাল বেলা যখন শুকনো শরীর ফুলে মোটা কিংবা রক্তাক্ত দেখা যেতোতখনই বোঝা যেতো আসল অবস্থা  নিয়ে নানা রকম হাসি ঠাট্টাও জমতো একে-অপরকে নিয়ে আবার বৃষ্টির দিনে দেখা যেতো কেউ ভিজে জবজবে হয়ে কাজে বসে পড়লেন শীতের দিতে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে এসে হিটার জ্বালিয়ে আগুন পোহাতে লাগলেন কিংবা রাতে ছাপা নিউজপ্রিন্ট গায়ে দিয়ে সেগুলোকেই লেপ-কাঁথা বানাতেন। এরকম নানা ঘটনা এতে কারও কোন আক্ষেপ ছিল না ছিল কেবলই উৎসাহ আর উদ্দীপনা আর এই সময় যদি রতন ভাই নিচের ভাজা সিঙারা বা চপ কিনে নিয়ে হাজির হতেনতখন আনন্দের শেষ ছিল না ঝাল-মুড়ির আড্ডা ছিল আরও মজার

এই বিবৃতিতে আমরা খবর লিখতামসে খবর দেখে দিতেন শিবজিত দা তারপর সেই খবর হ্যান্ড কম্পোজ হতো কখনও কখনও বিশেষ কারণে কম্পোজিটর না এলে তখন নিজেরাই বসে একটা একটা করে টাইপ তুলে স্টিকে বসিয়ে কম্পোজ করতে হতো এখানেই শেষ নয় সেই কম্পোজ করা ম্যাটার টাইট করে বেঁধে নিচে নামিয়ে কালি ডলতে হতো রুলার দিয়ে তারপর তার উপর নিউজপ্রিন্ট সেঁটে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে চাপতে হতো তাতেকরে যে ছাপ বসতোসেগুলোর প্রুফ হিসেবে নিজেদেরই দেখে ঠিক করতে হতো সবকিছু চূড়ান্ত হলে সেই ম্যাটার প্রেসে যেতো প্রেসেও আমাদের দাঁড়িয়ে সহযোগিতা করতে হতো কাগজের বান্ডিল গোছাতে হতো তখনকার দিনের কাজই ছিল এইরকম একের ভিতর বহুগুণ বলা যায় একে এরপর সবকিছু ঠিক থাকলে ভোর বেলা জয়নাল ভাই বাইসাইকেল নিয়ে বের হতেন পত্রিকা বিলি করতে তিনি একাধারে বিজ্ঞাপন ম্যানেজারসার্কুলেশন ম্যানেজারহকার এবং বিল কালেক্টর আমাদের সবার কাজই ছিল এই রকমের কে যে কী দায়িত্বেরএসব ছিল না সব কাজই ছিল সবার আমরা আবার নতুন গ্রাহক তৈরির জন্য দল বেঁধে মাঠেও নামতাম এতেকরে মানুষ সাড়া দিতেন দারুণভাবে লাফিয়ে লাফিয়ে পত্রিকার সার্কুলেশন বেড়ে যেতো আমাদের এইসব কাজ দেখে এগিয়ে এসেছিলেন অনেক প্রথিতযমা মানুষ যেমন এসেছিলেন সাংবাদিক আনোয়ারুল হকএডভোকেট রণেশ মৈত্রঅধ্যাপক মনোয়ার হোসেন জাহেদীডারাম দুলাল ভৌমিকঅধ্যাপক আবদুল মান্নান তালুকদারমীর্জা শামসুল ইসলামআবদুল মতীন খানরবিউল ইসলাম রবিসুশীল তরফদারসহ অনেকে পরে কর্মী হিসেবে আরও অনেকেই আড্ডার মহোৎসবে যোগ দিতেন এবং তাঁরাও বিবৃতির পরিবার হয়ে ওঠেন

 

---- চলবে -----


 স্মৃতিকথাসাত

 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

 

সাত.

আশির দশকের সময়গুলো এখনকার মত ছিল না রিপোর্টিংয়ের জন্য আমাদের পায়ে হেঁটে কিলোমিটারের পর কিলোমিটার গিয়ে বিটে পৌছাতে হতো পায়ে হাঁটার কারণটা অর্থনৈতিক আমাদের এমন টাকা-পয়সা ছিল নাযা দিয়ে রিকশায় যাবো যদিও রিকশা ভাড়া এখনকার মত ছিল না অফিস থেকে ডিসি অফিসের দূরত্ব আড়াই-তিন কিলোমিটার মত রিকশা ভাড়া চার আনা থেকে আট আনা ছিল মানে এক টাকার চার ভাগের একভাগ বা আধা ভাগ সেটাও আমাদের জন্য খরচ করা বেশ কঠিন ছিল বোঝার জন্য বলছিআমি যখন বিবৃতির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করিতখন বেতন বা সম্মানী ছিল না কিন্তু পরে রতন ভাই একটা টোকেন সম্মানী দেওয়া শুরু করলেন যার পরিমাণ ছিল মাসে দেড়শ টাকা মানে পত্রিকার সম্পাদকের সম্মানী দেড়শ টাকা মাসিক এই দেড়শ টাকাকে দেখতে হবে এখনকার হিসাবে আরও দুই শূন্য যোগ করে অর্থাৎ তার পরিমাণ ১৫ হাজার টাকা সুতরাং রিকশা ভাড়া চারআনা-আটআনাকে কম পয়সা বলা যাবে না

আমরা রিকশায় চড়তাম না আমাদের সম্পাদক শিবজিত দাও রিকশায় চড়ে সাংবাদিকতা করেছেনএমনটি দেখেছি বলে মনে পড়ে না বরং তিনিও দল বেধে হেঁটে হেঁটে আমাদের সঙ্গে যেতেন নিয়মিত রিকশায় চড়তেন কেবলমাত্র আমাদের প্রকাশক ইয়াসিন আলী মৃধা রতন কারণ ওই সময় পাবনার সবচেয়ে প্রভাবশালী বা মান্যগণ্য ব্যক্তিদের অন্যতম ছিলেন তিনি মটর মালিক হিসেবে তাঁর নামডাক ছিল উপরের সারীতে এক নামেই তাঁকে চিনতের পাবনার সব মানুষ তাই তাঁর পায়ে হেঁটে চলাটা মানানসই ছিল না

 

যাই হোকআমরা হেঁটে খবর পাওয়ার যায়গাগুলোতে যেতামসেখান থেকে তথ্য-উপাত্ত বা সাক্ষাৎকার নোটবুকে টুকে নিয়ে আসতাম তারপর অফিসে বসে লিখতাম তবে হ্যাঁআমাদের গাড়ি বা মটরসাইকেল না থাকলেও কাজের জন্য দ্রæতযান একটা ছিল সেটা হলো জয়নালের বাইসাইকেল বিবৃতির ওই একটাই বাইসাইকেল সেটা বিজ্ঞাপন সংগ্রহপত্রিকা বিলিবিল কালেকশনের কাজ ছাড়াও খবর সংগ্রহের জন্য আমরা ব্যবহার করতাম

রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য আমরা কখনও একাআবার কখনও দল বেঁধে যেতাম শিবজিত দারতন ভাইও প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে যেতেন আর রিপোর্ট বলতে আমরা জনস্বার্থ সংক্রান্ত নানান তথ্য সংগ্রহ করতাম নানা ঘটনার খবর সংগ্রহ করতাম গোপন থাকা অনিয়ম-দুর্নীতির ঘটনা জনগণের সামনে প্রকাশ করে দিতাম  ক্ষেত্রে কোনরকম ব্লাকমেইল বা স্বার্থ হাসিলের চিন্তা আমাদের ছিল না এমন কাজকে আমরা সাংবাদিকতার নীতি এবং আমাদের নৈতিক আদর্শের পুরো পরিপন্থী হিসেবে বিবেচনা করতাম যদিও শেষ পর্যন্ত এরকম নৈতিকতা পাবনায় শতভাগ টিকে থাকেনি আশির দশকের মাঝামাঝির দিক থেকে সামরিক শাসক এরশাদ তার হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সাংবাদিকদের নষ্ট করে দিতে থাকেন নিজেদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে দেন লোভ-লালসায় ফেলে কারও কারও নৈতিকতাকে ধ্বংস করে দেওয়ার চেষ্টা করেন তবে এর শিকার খুব কমজনই হয়েছেন কারণ তখন নৈতিকতার শক্তিরই প্রাধান্য ছিল

আমাদের এই সময়টাতে সাংবাদিকদের যে কী মর্যাদা ছিলতা এখন কল্পনাও করা যায় না মানুষ দেশের প্রেসিডেন্ট-প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রী বা ডিসি-এসপিকে যতোটা না গুরুত্ব দিয়েছেনতার চেয়ে অনেক বেশি সাংবাদিকদের মর্যাদা  সম্মান দিয়েছেন

 

 সময় আমরা অনুসন্ধানমূলক রিপোর্টিংয়ের জন্য নানান পন্থা অবলম্বন করেছি একবার শুচি সৈয়দ আর আমি অফিস থেকে ছুটলাম সিঙ্গা গ্রামের অনেক ভেতরের দিকে আমরা অফিসে বসে একটা হিসাব-নিকাশ করেছিলাম তখন পাবনার উপর দিয়ে আন্তঃনগর ৩৩ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে যাওয়া হয়েছিল কোথা থেকে যেন খবর পেয়েছিলাম যেবিদেশিদের অর্থে নির্মিত এই লাইন স্থাপনে বড় রকমের দুর্নীতি করা হয়েছে শহরের দিকে লাইনের উচ্চতা যে পরিমাণ করা হয়েছিলগ্রামের দিকে গিয়ে সেই লাইনে একটা করে ধাপ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে এতেকরে উচ্চতা কমে গেছেএবং এক-একটি ধাপ বাবদ লাখ লাখ টাকা লোপাট হয়েছে এই তথ্যটা সরেজমিনে কীভাবে যাচাই করা যায়তারই একটা হিসাব তৈরি করেছিলাম আমাদের কাছে প্রশ্ন ছিললাইনে ধাপ কম বসানো হয়েছেতা প্রমাণ করবো কীভাবেলাইন দেখে তো তা বোঝা যাব না সুতরাং উচ্চতা মাপতে হবে সেটা কীভাবে সম্ভব৩৩ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ লাইনের উচ্চতা মাপার চিন্তা পাগলামো ছাড়া কিছু নয় কারণ বেশ কিছুদিন আগে শহরের ভেতর দিয়ে যাওয়া লাইনের নিচে কাজ করছিলেন বিদ্যুৎ অফিসের এক কর্মী হঠাৎই তিনি ১১ হাজার ভোল্টেজের প্রভাবে নিমেষেই পুড়ে ছাই হয়ে যান কয়লার গুড়ো ছাড়া তার শরীরের আর কিছু পাওয়া যায়নি এডওয়ার্ড কলেজ গেটের সামনে এঘটনা ঘটেছিল সুতরাং অভিজ্ঞ বিদ্যুৎ অফিসের লোকেরই যখন ১১ হাজার ভোল্টেজে এই দশা হয়েছেতখন ৩৩ হাজারে আরও কী না হতে পারে!

তাই বলে আমরা হাল ছাড়িনি বইপত্র পড়ে বিদ্যুৎ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করেছিলাম তারপর আমরা পরিকল্পনামত শহর থেকে হেঁটে অন্তত ১২/১৪ কিলোমিটার দূরে সিঙ্গা এলাকায় খোলা মাঠের ধান ক্ষেতের মধ্যে চলে যাই  সেখানে কোন জনবসতি ছিল না আমাদের দুটি পন্থা গ্রহণ করা ছিল এক হচ্ছেশুকনো মোটা সুতো নিয়েছিলাম সেটার মাথায় ইটের দলা বেঁধে বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইনের উপর ছুঁড়ে দিয়েছি অতো উপরে সহজেই এটা করা যায়নি অনেকবার চেষ্টার পর বিদ্যুৎ লাইনের উপর দিয়ে সেটা পাঠাতে পেরেছিলাম তারপর সুতো ঢিল দিয়ে ইটের দলাকে নিচে নামিয়েছিলাম জ্ঞান অর্জন থেকে জানতাম শুকনো সুতোয় বিদ্যুৎ প্রবাহের ভয় নেই তারপরেও ৩৩ হাজার ভোল্টেজ বলে কথা নানাভাবে পরীক্ষা করে যখন নিশ্চিত হয়েছিতখনই সেই সুতোকে হাত ধরেছি এভাবে সুতো দিয়ে লাইনের উচ্চতা মেপেছি আরেকটি পন্থা ছিলসূর্য্যরে আলোতে মাটিতে পড়া বিদ্যুৎ থাম্বার ছায়া মাপা আমরা পড়াশুনা করে একটা হিসাব বের করেছিলাম সেইমত থাম্বার মাপ নিচ্ছিলাম দীর্ঘ সময় ধরে এক জায়গায় নয়প্রয়োজনীয় কয়েক জায়গায় গিয়ে একইভাবে মাপগুলো নেওয়া হয় কাজটি যেমন ছিল দুঃসাহসিকতেমন ছিল বেশ পাগলামিপূর্ণ

 

এই বিদ্যুৎ লাইন নিয়ে এর আগে আরেকটি অভিযান চালানো হয়েছিল সম্পাদক শিবজিত নাগশ্যামল দত্তশুচি সৈয়দমুকুল আহমেদমোস্তাফা আরব সতেজঅমল সরকারআমিসহ বেশ কয়েকজন গিয়েছিলাম শহর থেকে দূরে আতাইকুলায় সেখান থেকে এই বিদ্যুৎ লাইন সম্পর্কে খোঁজ নিতে আরও দূরে একেবারে গ্রামের ভেতর চলে যাই কারণ তখন সবেমাত্র এই ৩৩ হাজার ভোল্টেজের বিদ্যুৎ লাইন চালু করা হচ্ছে  নিয়ে নানা রকম কথাও কানে এসেছে সেসব যাচাই করতেই আতাইকুলা যাওয়া

আমরা সরেজমিনে প্রত্যক্ষ করলামওই বিদ্যুৎ লাইনের নিচ দিয়ে যেসব টিনের বাড়িঘর রয়েছেসেগুলো আপনা-আপনি বিদ্যুতায়িত হয়ে থাকছে এই বিদ্যুৎ দিয়ে তারা লাইট জ্বালাচ্ছেনব্যাটারির বদলে টিনের সঙ্গে কানেকশন লাগিয়ে রেডিও চালাচ্ছেন কেও কেউ রান্নার জন্য বৈদ্যুতিক হিটারও ব্যবহার করছেন। ব্যাপারটা সাংঘাতিক ভয়াবহ রকমের দুর্ঘটনা  প্রাণহাণীর ঘটনা ঘটতে পারে অবশ্য গ্রামবাসী জানালেনসেরকম কোন দুর্ঘটনা এখনও ঘটেনি তবে টিনে হাত দিলে শক খেতে হচ্ছে সে কারণে তারা সাবধানে থাকছেন সত্যিই শক খেতে হয় কিনাতা যাচাই করার জন্য মুকুল আহমেদ সাহস করে টিনে হাত দিয়ে দেখতে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে শক খেয়ে তিনি ছিটকে পড়লেন সবাই বুঝতে পারলামব্যাপারটাকে গ্রামবাসী যতো সহজভাবেই নিন না কেনÑ এটা রীতিমত ভয়ঙ্কর বিপদজনক

 

অনেকগুলো অবস্থান আমরা পর্যবেক্ষণ করলাম সব জায়গায়ই দেখা গেলবাড়িঘর থেকে বিদ্যুৎ লাইন অনেক উপরে তারপরেও বিদ্যুতায়িত হচ্ছে টিনের ঘরগুলো

ব্যাপারটা সংবাদ আকারে তুলে ধরতে আমরা শহরে এসেই লেখা শুরু করে দিলাম শুধু আমরাই নয়খবর অন্যদের দিয়ে দিলাম তাঁরাও রিপোর্ট তৈরি করে পাঠালেন পরদিন বিবৃতি ছাড়াও সংবাদইত্তেফাকগণকণ্ঠকিষাণসহ বেশ কতগুলো সংবাদপত্রে ফলাও করে  খবর প্রকাশ হলো এনিয়ে হইচই পড়ে গেল একদিন পর বিদ্যুৎ কর্তৃপক্ষ ঘটনার কারণ  টেকনিক্যাল ব্যাখা দিয়ে বিজ্ঞপিও দিলো

 

------- চলবে --------


 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

 

আবুল হোসেন খোকন

 

আট.

সাপ্তাহিক বিবৃতিতে আমরা কতগুলো বিশেষ দায়িত্ব পালন করতাম যেমন সম্পাদক শিবজিত দা পত্রিকার সবকিছু দেখাশুনা এবং সম্পাদকীয় লেখা ছাড়াও ছদ্মনামে কলাম লিখতেন 'নির্গুণ ঢুলি নামে লেখা তাঁর কলামটি ছিল তৃণমূলের মানুষসহ উপরের মানুষের কাছে খুবই প্রিয় এবং অকর্ষণীয় বিবৃতির সম্পাদকীয়ও ছিল খুবই সহজ-সরলসুপাঠ্যঅথচ উচ্চমার্গের পত্রিকার নিউজসহ সবকিছুই ছিল গোছালোসৃজনশীল যে কারণে সংবাদপত্রের জগতে বিবৃতি ছিল ভাবমূর্তি সম্পণœ একটি ভিন্নধর্মী পত্রিকা জাতীয়ভাবে সাপ্তাহিক সংবাদপত্রের মধ্যে জনপ্রিয় ছিল সাপ্তাহিক একতাএর পরেই ছিল সাপ্তাহিক বিবৃতি

বিবৃতি পরিবারের সবার মধ্যে ছিল অন্যরকম মেধাসৃজনশীলতাএকনিষ্ঠতাত্যাগের মনোভাবজনগণমুখিতাসততা এবং বস্তুনিষ্ঠতা এমন আদর্শিক অবস্থানকে ভিত্তি করেই আমরা যার যার মত লিখতাম এবং কাজ করতাম শুচি সৈয়দ বিবৃতির সাহিত্য পাতা দেখতেন তাঁকে ঢাকা থেকে সহযোগিতা করতেন শ্যামল দত্ত সমজিৎ পাল ছিলেন জনপ্রিয় ছড়াকার তিনিও  পাতার দায়িত্ব পালন করতেন তাঁর কারণেই বিবৃতি উপস্থাপন করতো 'ছড়া কার্টুন নামের ব্যতিক্রর্মী ব্যাঙ্গ কার্টুন দেশের মধ্যে এটা ছিল নতুন এবং কার্টুনের ভিন্ন এক ধরণ জাতীয়ভাবে দৈনিক বাংলায় রফিকুন নবীর (রনবীকার্টুনের পর দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল ছড়া কার্টুন  কার্টুনে ছবি থাকতো নাতার বদলে থাকতো শুধুই ছড়া যা দিয়ে সারা জাগানো ব্যাঙ্গ তুলে ধরা হতো অবশ্য এক পর্যায়ে ছড়ার সঙ্গে নিজেদের আঁকা কার্টুন ছবিও যুক্ত করা হয় সমজিৎ পাল যখন পড়াশুনার জন্য ময়মনসিংহ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ে চলে যানতখন বাকি সবাই মিলে আমরা ছড়া কার্টুন রচনা বা সংগ্রহ করতাম

বিবৃতি ছিল বহুমুখি প্রতিভা বিকাশের ক্ষেত্র লেখক হিসেবে শিবজিত দাজাহাঙ্গির আলম মুকুলমকুল আহমেদশ্যামল দত্তশুচি সৈয়দসমজিৎ পালমোস্তাফা আরব সতেজঅমল কান্তি সরকার এবং অন্যান্যরা একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করতাম আমরা ছিলাম একাধারে সংবাদ লেখককবিতা লেখকগল্প লেখকসম্পাদকীয় লেখকউপ-সম্পাদকীয় লেখকপ্রবন্ধ লেখক ইত্যাদি সব সবাই  কাজগুলো করতাম একটি সংবাদপত্রে যা কিছু থাকা প্রয়োজনতার সবই আমরা নিজেরা দিতে সক্ষম হয়ে উঠেছিলাম এমন ঘটনাকে নজীরবিহীন বললে ভুল হবে না

 

অনেক দু:-কষ্টের মধ্যেও আমাদের কর্মদিনগুলো ছিল আনন্দ এবং উৎসবমূখর প্রায়শই দেশের সেরা সেরা ব্যক্তিত্বদের নিয়ে এসে বণমালী ইনস্টিটিউটঅন্নদা গোবিন্দ পাবলিক লাইব্রেরি মিলনায়তনপাবনা প্রেসক্লাব মিলনায়তনে করা হতো জমকানো অনুষ্ঠানমালা নানান দিবস  পর্বের দিনগুলো উদযাপন করা হতো ব্যাপক ধূমধামের মধ্যদিয়ে করা হতো আনন্দ ভ্রমণপিকনিক সব কিছু মিলে পত্রিকার বিস্তৃতিগ্রহণযোগ্যতা এবং সুনাম এমনই পর্যায়ে চলে গিয়েছিল যেরাজধানীর নামী-দামি ব্যক্তিত্বরা বিবৃতির নাম শোনা মাত্র একবাক্যে ছুটে আসতেন এরকম প্রেক্ষাপট কোন মফঃস্বল শহরের জন্য ছিল একেবারেই ব্যতিক্রমী

 

একটা পর্যায়ে এসে বিভিন্ন সংস্কৃতিমনা কর্মীসংগঠক এবং ব্যক্তিত্বদের বড় অড্ডার জায়গা হয়ে ওঠে বিবৃতি আগেই বলেছিএখান থেকেই জন্ম নেয় প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক সংগঠন 'গণশিল্পী সংস্থা এর যিনি প্রধান ছিলেনসেই জাতীয়  আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পণœ ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী নিজে এসে এই সংগঠনের উদ্বোধন করেন পরবর্তীতে এই গণশিল্পী সংস্থার যাবতীয় কাজকর্মের জায়গা হয়ে ওঠে বিবৃতি এতেকরে বিবৃতির স্বাভাবিক কাজকর্মে কিছুটা ব্যাঘাত শুরু হয় কিন্তু প্রকাশকসম্পাদক থেকে শুরু করে কারোরই এতে কখনও আপত্তি ছিল না বরং ছিল উৎসাহ আর উৎসাহ ফলে শিল্পীদের যতো রকম মহড়া-প্রশিক্ষণ তার সবই এখানে হতো এমনকি গণশিল্পীর যাবতীয় সাজ-সরঞ্জামও রাখা হতো এখানে এসব ঘটনায় বিবৃতির জনসম্পৃক্ততা ক্রমেই বেড়েছে সব সময় জমজমাট থাকতো অফিস আমাদের গুটিকয় সংবাদকর্মীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান প্রবীণ সাংবাদিক আনোয়ারুল হকসাংবাদিক রবিউল ইসলাম রবিসাংবাদিক আবদুল মতীন খানপ্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডাইলিয়াস ইফতেখার রসুলদন্ত চিকিৎসক ডামনোয়ার উল আজীজডারাম দুলাল ভৌমিকআবৃত্তি প্রশিক্ষক সরোয়ার খান মিলনগণশিল্পীর রাশেদুর রহমান রঞ্জুঅমল সাহামোশফেকা জাহান কণিকামতিনুল হাসান মতিনরেজানুর রহমান রোজরুচিরা সুলতানাসাইফুল হক লিটনশ্যামল দাসউত্তম দাসনূর উজ জামান খোকনউজ্জ্বল সাহামির্জা আজাদসাব্বির আহমেদ খান লেনিননাট্যকার ইজিবর রহমানঅভিনেতা গণেশ দাসনাজিম উদ্দিন সরদার খোকাশামীম আহমেদ বাবুখালেদ হাসান মিলনভাস্কর চৌধুরীশিপ্রা ভৌমিকবকুল ভৌমিকবিপ্লব ভৌমিকনাজমুল হক মণ্টুসুবহানী বাবুআবদুল বাতেন আলোকশাহ আলম সিদ্দিকী খসরুসাদিক উল হাসনাত জিশানসহ অনেকে

 

 

সবকিছুরই উত্থান থাকেপতন বা বিপর্যয়ও থাকে আমাদের ঠিক তেমনটা ছিল না তবে একটা পর্যায়ে শিবজিত দার পক্ষে আর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা সম্ভব হয়নি প্রতিকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাঁকে নানাভাবে ঘায়েল করার চেষ্টা করছিল তাঁকে পাবনা থেকে বদলিও করে দেওযা হয় তিনি চলে গেলে ওই দায়িত্বে আমাকে আসতে হয়েছিল এর আগে শুচি সৈয়দ পাবনা বার্তায় যুক্ত হন সমজিৎ পাল পড়াশুনার জন্য ময়মনসিংহ চলে যান মুকুল আহমেদ নিজস্ব ব্যবসায়িক কাজে মনোযোগী হয়ে ওঠেন মোস্তাফা আর সতেজ ঢাকা চলে যান ফলে কমতে কমতে পুরনোদের অনেকেই নাই হয়ে যান অন্তত পাঁচ বছর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর আমাকেও এখানে নিস্ক্রীয় হয়ে উঠতে হয় কারণ আমি নিজে গণশিল্পী সংস্থার কাজে এতো বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ি যেতখন সম্পাদনার দায়িত্ব থেকে অব্যহতি গ্রহণ ছাড়া পথ ছিল না

 

বিশেষ করে তখন সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপট মোটেও সুবিধাজনক ছিল না জান্তা সরকার চারদিকে চক্রান্ত করে সুস্থ পরিবেশ নস্যাৎ করে দেওয়ার চেষ্টা করছিল সারাদেশে দমন-পীড়ন-হত্যা-গুম ইত্যাদি সকল সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছিল প্রতিবাদে দেশও ফুঁসে উঠেছিল তখন আমার কাছে মনে হয়েছিলসারা দেশের প্রগতিশীল-গণতন্ত্রকামী মানুষ জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াচ্ছে আমাদেরও রুখে দাঁড়ানো উচিত কিন্তু একটি পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বে থেকে সরাসরি সেটা করা সম্ভব নয় বাধ্য হয়ে সার্বক্ষণিক সাংবাদিকতার কাজ স্থগিত রাখার কথা ভাবতে হয় এর বদলে সাংস্কৃতিক কর্মসূচি নিয়ে আন্দোলনের ঝাঁপিয়ে পড়াটাই উত্তম মনে হয়েছিল সামরিক সরকার একের পর এক এমন সব ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করছিলযাতে প্রগতিশীলগণতান্ত্রিক এবং সৃষ্টিশীল কাজকর্ম রীতিমত হুমকির মুখে পড়ে যায় এর মোকাবিলা করা এবং লড়াইয়ের জন্য রুখে দাঁড়ানোটাকেই শ্রেষ্ঠ কাজ বলে বিবেচনায় এসেছিল সেই সূত্রেই বিবৃতি ছেড়ে সার্বক্ষণিকভাবে গণশিল্পীর হয়ে কাজে নেমে পড়ি

 

ঠিক এরকম একটা সময় পাবনার পুরনো সাংবাদিকদের সঙ্গে যুক্ত হন অনেকগুলো নতুন মুখ নতুন বললে সম্ভবত ঠিক হবে না কারণ তাঁদের অনেকেই বেশ আগে থেকে সাংবাদিকতা করে আসছিলেনকিন্তু সেভাবে দৃর্শপটে আসেননি এই প্রেক্ষাপটে তারা দৃশ্যপটে চলে আসা শুরু করেন  সময় পর্যন্ত পুরনো সাংবাদিক ছিলেন (প্রেসক্লাবের তালিকা অনুযায়ীআজিজুল হকরণেশ মৈত্রআনোয়রুল হকহাসনাত উজ জামান হীরামির্জা শামসুল ইসলামশফি আহমেদপ্রসাদ রায়আলী রেজাকরিম দারা১০রবিউল ইসলাম রবি১১একরামুল হক১২হামিদুল ইসলাম১৩শিবজিত নাগ১৪আবদুল মতীন খান১৫আবদুস সাত্তার বাসু১৬   আবদুল আউয়াল খান১৭আবদুল কুদ্দুস চাঁদু১৮আবদুর রশিদ বেনু১৯দুলাল চন্দ্র কুন্ডু২০আবুল হোসেন খোকন২১আমিনুল ইসলাম২২সাহাবুদ্দিন চুপ্পু২৩সুশীল তরফদার২৪মোস্তাফিজুর রহমান চন্দন২৫ইয়াসিন আলী মৃধা রতন২৬ইসমাইল হোসেন শুচি (শুচি সৈয়দ), ২৭সেরাজুল ইসলাম তোতা২৮মুহম্মদ মহিউদ্দীন এবং ২৯আমিরুল ইসলাম এই তালিকার সঙ্গে নতুন যুক্ত হলেন ৩০আবদুল মজিদ দুদু৩১রাশেদুর রহমান রঞ্জু৩২গোলাম কাওসার৩৩মোস্তাফা আরব সতেজ (পুরনো সাংবাদিককিন্তু ক্লাবের সদস্য হন পরে), ৩৪ওয়াহেদ হোসেন৩৫আবদুস সবুর খান হা-মীম৩৬মুরশাদ সুবহানী বাবু৩৭জহরুল হক৩৮শফিউর রহমান খান (পুরনো সাংবাদিক হলেও ক্লাবের সদস্য হন অনেক পরে), ৩৯ বি এম ফজলুর রহমান৪০ কা  আজিজল হক (তথ্য কর্মকর্তা), ৪১মাহমুদুল হাসান বাদশা৪২আবদুল্লাহ আল মাহমুদ এবং ৪৩আখতারুজ্জামান আকতার

 

---- চলবে -----


 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

 

নয়.

টানা সাংস্কৃতিক আন্দোলনে দারুণ ফল মিললো সামরিক জান্তা  সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীদের বিরুদ্ধে খুব দ্রুতই তৈরি হয়ে গেল গণজোয়ার মানুষ রাস্তায় নেমে পড়লেন বাধ্য হয়ে পিছু হটলো জান্তা সরকারসহ তার সহযোগিরা এইসঙ্গে গণঅভ্যুত্থান অনিবার্য হয়ে উঠলো পাবনার সঙ্গে সারাদেশ হলো একাট্টা

এমন প্রেক্ষাপট তৈরি করতে পাবনায় নাট্য  সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো যে ভূমিকা পালন করেছেতা সারাদেশের মধ্যে ছিল বিরল রাজনৈতিক দলগুলো যখন গাঢাকা দেওয়া অবস্থায়রুখে দাঁড়াবার কেউ নেইতখন সাংস্কৃতিক কর্মীরা সামরিক জান্তার জারি করা জরুরি আইন ভঙ্গ করেছে রাজপথ কাঁপিয়েছে একটানা যদিও  জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে নেতাকর্মীদের কর্মসূচিতে পুলিশি হামলা হয়েছে তিনজন সংগঠককে জেলেও যেতে হয়েছে কিন্তু বিজয় ঠেকানো যায়নি এক পর্যায়ে সফল হয় নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান

 

বিজয়ের পর আপাত কাজ শেষ হয় আমার জন্য আবার সাংবাদিকতায় ফিরে যাওয়া জরুরি হয়ে ওঠে ঠিক এরকম একটি সময়েই নতুন ঘটনা ঘটলো

সাঁথিয়ার সাংবাদিক হাবিবুর রহমান স্বপন একটি সাপ্তাহিক সংবাদপত্র প্রকাশের উদ্যোগ নেন তিনি একাধারে বিচক্ষণঅনুসন্ধানী এবং বেশ সচেতন সাংবাদিক নানা কারণেই তিনি ছিলেন সুপরিচিত পাবনাতে তাঁরসঙ্গে সবচেয়ে বেশি খাতির ছিল শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক আবদুল মতীন খানের সাঁথিয়া থেকে পাবনা শহরে এলে তিনি মতীন ভাইয়ের বাড়িতেই রাত কাটাতেন প্রেসক্লাব এবং সাংবাদিক মহলের সঙ্গে ছিল তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক

নতুন সংবাদপত্র বের করার ব্যাপারে তিনি প্রথমে আলোচনা করেন মতীন ভাইয়ের সঙ্গে তারপর আমাকে নিয়ে বসেন বসার মধ্যদিয়ে সংবাদপত্রটির নামএর প্রকাশক-সম্পাদক এবং অন্যান্য দায়িত্ব পালনকারীদের নাম চূড়ান্ত করা হয় প্রকাশক হিসেবে থাকেন হাবিবুর রহমান স্বপন নিজেই সম্পাদক হিসেবে নাম আসে মতীন ভাইয়ের কিন্তু তিনি সরকারি চাকরি করেন বলে আপত্তি তোলেন তখন আমার নামটি চূড়ান্ত হয় এভাবেই আমাকে 'সাপ্তাহিক পাবনা নামের সংবাদপত্রটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়

কিন্তু খুব দ্রুত সময়েই সংবাদপত্রটি চালানোর জন্য খরচ সংকুলান কঠিন হয়ে দাঁড়ায় একটা অফিস নেওয়া হয় নিউ মার্কেট গেটের সামনে অল্প-স্বল্প আসাবাবপত্র নিয়ে বসার ব্যবস্থা হয় অল্প কয়েকজনকে নিয়ে শুরু হয় পত্রিকার কাজও ছাপার জন্য নিজস্ব কোন প্রেস ছিল না ফলে বিভিন্ন প্রেসে ধর্ণা দেওয়ার ঝামেলা পোহাতে হচ্ছিল এর মধ্যদিয়েই আমরা রিপোর্টিংসংম্পাদকীয়উপ-সম্পাদকীয়সহ সমুদয় লেখালেখির কাজ চালাতে থাকি আমাদের মধ্যে মূল কাজের লোক হলাম আমি ছাড়াওমতীন ভাইস্বপন ভাইসুশীল তরফদার প্রমুখ এক পর্যায়ে ঠিক হলোছাপার কাজটা বগুড়া থেকে করার সে অনুযায়ী এরপর শুরু হলো ম্যাটার নিয়ে বগুড়া যাতায়াত  কাজটা আমাকেই করতে হচ্ছিল তবে প্রতি সপ্তাহে এভাবে কাজ করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়ালো সবচেয়ে সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো টাকা-পয়সার প্রথম প্রথম বগুড়ার মুকুল প্রেসপ্রবীণ সাংবাদিক জাহেদুর রহমান যাদুহাসিবুর রহমান বিলু খুব সহযোগিতা করছিলেন কিন্তু টাকা-পয়সার অভাবে নানা সমস্যা তৈরি হলো শেষ পর্যন্ত পত্রিকা টিকিয়ে রাখাই কঠিন হয়ে উঠলো যদিও পাবনাতে খুব দ্রুতই সাপ্তাহিক পাবনার সার্কুলেশন বেড়ে গিয়েছিল মানুষের মধ্যে দারুণ চাহিদা তৈরি হয়েছিল কিন্তু বিবৃতির মত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় এক সময় এর নিয়মিত প্রকাশনাই বন্ধ হয়ে গেল

 

এদিকে ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য তখন জীবনধারণ খুব কঠিন হয়ে উঠেছিল কোন আয়ের উৎস ছিল না সাপ্তাহিক পাবনার সম্পাদক হলেও কোন বেতন-সম্মানী ছিল না এক কথায় সবাই আমরা স্বেচ্ছাশ্রমে কাজ করছিলাম আমি অবশ্য কয়েকটি প্রাইভেট পড়াতাম তাই দিয়ে কোন রকমে থাকা-খাওয়া চালাতাম

কিন্তু এক সময় অবস্থাটা এমন দাঁড়ালো যেআর টেকা সম্ভব নয় তখন বাধ্য হয়ে অন্য কোথাও চাকরির চিন্তা করতে হলো শ্রদ্ধেয় কামাল লোহানী আমার বিষয়টা জানতেন তিনি সবসময় খোঁজখবর নিতেন আমার অবস্থা জেনে তিনি চাকরির জন্য জোর চেষ্টা শুরু করলেন এক পর্যায়ে বগুড়া যাওয়ার পরামর্শ দিলেন তার আগে চাকরির ব্যাপারে সেখানকার মুহম্মদ মাহবুব উল আলম টোকন ভাইয়ের সম্পাদিত 'দৈনিক উত্তরবর্তা সঙ্গে কথা বললেন টোকন ভাই আমার মতই লোহানী ভাইয়ের খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন লোহানী ভাই বলা মাত্র তিনি আমাকে সহকারী সম্পাদক হিসেবে নেওয়ার জন্য ডাকলেন অবশ্য তখনও আমি যোগ দেবো কি দেবো নাদ্বিধাদ্বন্দ্বে ভূগছিলাম  অবস্থায় একদিন আমাদেরই সহযোদ্ধা আবদুল জব্বার ভাই আমাকে জোর করে ধরে বগুড়া নিয়ে গেলেন এবং দৈনিক উত্তরবার্তায় দেখা করিয়ে সেখানে যুক্ত করে দিলেন জব্বার ভাই দৈনিক উত্তরবার্তার পাবনা প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করছিলেন পরে জেনেছিলামসম্পাদক টোকন ভাইয়ের নির্দেশেই তিনি আমাকে বগুড়ায় ধরে নিয়ে তাঁরসঙ্গে দেখা করান এভাবেই ঘটলো পাবনা থেকে বগুড়ার সংবাদপত্রে যুক্ত হবার ঘটনা

 

উত্তরবার্তায় যোগ দিয়ে নতুন এক জীবন ফিরে পেলাম সম্পাদক টোকন ভাই আমার ব্যাপারে একান্তই আপনজনের মত ভূমিকা রাখছিলেন  থেকে বোঝা যায়তিনি লোহানী ভাইকে কতোখানি মান্য করেন এই সংবাদপত্রটির অফিস ছিল শহরের মূল সাতমাথার কাছাকাছি কবি নজরুল ইসলাম সড়কে একটা তিনতলা ফ্লাট ভাড়া নিয়ে অফিস উপর তলায় বসেন সম্পাদক মাহবুব উল আলম টোকন দ্বিতীয় তলায় রিপোর্টিংএডিটিংবিজ্ঞাপন এবং অন্যান্য বিভাগ আমার বসার জায়গা হলো দ্বিতীয় তলায় এখানে বসেন ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক (যিনি সম্পর্কে সম্পাদকের খালুমুহম্মদ আবদুল মতীন সর্বজন শ্রদ্ধেয় মানুষ তিনি তিনিই টোকন ভাইকে সাংবাদিকতা শিখিয়েছেন সবমিলিয়ে আমারাও তাঁকে মতীন খালু বলে সম্বোধন করতাম

এখানে আমার সঙ্গী হন খালুর ছেলে আশিষ উর রহমান শুভপ্রদীপ ভট্টাচার্য্য শঙ্করআখতারুজ্জামান আখতারহাসিবুর রহমান বিলুসম্পাদকের ছোট ভাই মাহমুদুল আলম নয়নআবু বক্কর সিদ্দিকফটো সাংবাদিক শফিউল আজম কমল প্রমুখ বিজ্ঞাপন এবং সার্কুলেশনের মুল দায়িত্বে ছিলেন বাদশা ভাই বলে সম্পাদকের পছন্দের একজন সঙ্গে ছিলেন আবদুল হামিদ  ফয়েজ আহমদ

এখানে একটি কথা না বললেই নয় যেআমাকে খুবই আন্তরিকভাবে নিয়েছিলেন উত্তরাবর্তার সবাই পরে বগুড়ার সব সাংবাদিকই আমাকে একান্তই নিজের করে নিয়েছিলেন যে কারণে কখনও কোনদিন আমার কাছে মনে হয়নিএটা আমার জন্মস্থান নয় বলা যায়পাবনার চাইতেও সম্মান পাচ্ছিলাম এখানে আর আমিও বগুড়াকে গ্রহণ করেছিলাম আরেকটি জন্মভূমি হিসেবে

 

প্রথম দিকে টোকন ভাই আমাকে থাকার জন্য 'অন্নপূর্ণা নামে বিখ্যাত একটি হোটেলে রুম ঠিক করে দিয়েছিলেন খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছিলেন তাঁর বাড়ি থেকেই পরে অবশ্য আমি নিজেই সবার সহযোগিতায় ম্যাচ সিস্টেমে থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করে নিয়েছিলাম আমি যখন উত্তরবার্তায় যোগ দেই তখন বেতন ছিল ,২০০ টাকা একা চলার জন্য এটা অবশ্য যথেষ্ট ছিল এটা ছিল ১৯৯০-পরবর্তী সময়ের কথা

 

বগুড়ায় কাজ করতে এসে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্য করলাম টানা সামরিক জান্তা আর মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের শাসনে পদপিষ্ঠ থাকার  কারণে এখানকার কোন সংবাদপত্রই রাজাকার-আলবদর শব্দগুলো ব্যবহার করতো না এমনকি স্বাধীনতা দিবসবিজয় দিবসেও ওই চক্রের নাম উচ্চারণ করা হতো না 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী লেখা হতো না লেখা হতো 'দখলদার বাহিনী বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা হয়েছে দৈনিক উত্তরবার্তায়ও ছিল একই দশা আমি দেখলামএমন ধারা পাল্টানো দরকার

 অবস্থায় কোন জাতীয় দিবসের (বিজয় দিবস না স্বাধীনতা দিবস খেয়াল নেইনিউজ লেখার দায়িত্বটি আমাকে দিয়েছিলেন সম্পাদক টোকন ভাই আমি লেখার সময় স্পষ্টতই উল্লেখ করলাম 'রাজাকার 'আলবদর এবং 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শব্দ নিউজ দেখে আমার সঙ্গের অনেকেই চোখ কপালে তুলনেন বির বির করে বললেনএই শব্দগুলো বোধহয় ছাপানো যাবে না যাইহোকলেখাটি সম্পাদকের কাছে চূড়ান্তকরণের জন্য গেল টোকন ভাই আমাকে খুবই প্রাধান্য দিতেনবিশেষ করে লোহানী ভাইয়ের কারণে তিনি আমার কোন লেখাই কাটতেন না তিনি নিউজটি পড়ার সময় ওই শব্দগুলোর জায়গায় গিয়ে থমকে গেলেন কিছুক্ষণ ভাবলেন তারপর বিরবির করে বললেনবগুড়া রাজাকার-আলবদরদের ঘাঁটি এলাকা এখানে জামায়াতে ইসলামের প্রভাব খুবই বেশি তারপরেও আর কতদিন এদের ছাড় দেওয়া যায়আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেনআপনি যখন লিখেছেনতখন থাকুক দেখা যাক কী ফল হয়তিনি আর নিউজিটির কোথাও কাটলেন না

বগুড়ায় দীর্ঘ সময়ের পর এই প্রথম দৈনিক উত্তরবার্তায় জাতীয় দিবসে মুক্তিযুদ্ধের আসল ইতিহাসের কথাগুলো ছাপা হলো  নিয়ে সবাই একটু আতঙ্কে থাকলেও তেমন কোন উচ্চবাচ্য হলো না এরপর এভাবেই ইতিহাসের কথা লেখা শুরু হলো দৈনিক করতোয়ায়ও আস্তে আস্তে 'রাজাকার 'আলবদর এবং 'পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শব্দগুলো আসতে শুরু করলো

বগুড়ায় এসময় দুটি সংবাদপত্রই সবচেয়ে বেশি চলছিল একটি দৈনিক উত্তরবার্তাআরেকটি দৈনিক করতোয়া শ্রদ্ধেয় দুর্গাদাস মুখার্জীর দৈনিক উত্তরাঞ্চলের প্রকাশনা তখন বন্ধ ছিল

 

------ চলবে ------


রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

 

দশ.

আমি যখন উত্তরবার্তায় যোগদান করি তখন পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হচ্ছিল সালটি ছিল  আগস্ট ১৯৯০ এদিন ইরাকী বাহিনী আকস্মিক কুয়েত দখল করে নেয় যদিও পশ্চিমা দেশগুলো এই দখলকে আগ্রাসন বলে উল্লেখ করেবাস্তবে এটি ছিল ইরাকের পশ্চিমাবিরোধী সামর্থ প্রতিষ্ঠার একটি যুদ্ধ ইরাকী প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন মনে করতেনকুয়েত দখল করে দেশটির ভূগর্ভে থাকা বিপুল পরিমাণ তেলের মজুদ নিজের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিঅর্থনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে ইরাকই হয়ে উঠবে সর্বেসর্বা কুয়েতি তেল ভান্ডারের মালিক হতে পারলে পুরো বিশ্বের মোট জ্বালানির ২০ ভাগই ইরাকের নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে ইরাক পরিণত হবে খুবই শক্তিধর রাষ্ট্রে যা হবে মধ্যপ্রাচ্যে পশ্চিমাদের আধিপত্য রোখার জন্য সহায়ক তবে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হয়তো ধারণা করেননিএটা কখনই বাস্তবায়ন হতে দেবে না মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার মিত্ররা তারা মরিয়া হয়ে ইরাককে প্রতিহত করবে ফল তাই- হয়েছে ইরাকের কুয়েত দখলের পরপরই যুক্তরাষ্ট্র  ৩৪টি মিত্র দেশ মিলিতভাবে ইরাকের উপর সর্বাত্মকভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে শুরু হয় বিশ্ব কাঁপানো উপসাগর যুদ্ধ

 যুদ্ধ ছিল আমাদের দেশের সংবাদপত্রের জন্য বিরাট ব্যাপার অর্থাৎ এই যুদ্ধকে ঘিরেই খুলে যায় কাগজের ভাগ্য বেড়ে যায় কাটতি বগুড়ায় দৈনিক উত্তরবার্তা খুব চমৎকারভাবে এই যুদ্ধকে লুফে নিয়েছিল তখন উত্তরবার্তার সার্ক্যুলেশন ছিল হাজার পাঁচেকের মত একই অবস্থা ছিল আরেক প্রভাবশালী দৈনিক করতোয়ারও কিন্তু উপসাগর যুদ্ধ দৈনিক উত্তরবার্তার সার্ক্যুলেশন লাফিয়ে লাফিয়ে ১০ হাজার২০ হাজার৩০ হাজার৪০ হাজার৫০ হাজারসবশেষে ৬০ হাজার পর্যন্ত বাড়িয়ে দিয়েছিল শুধু উত্তরবার্তা নয়সম্পাদক মাহবুব উল আলম টোকন ভাই এই সুযোগে তাঁর পুরনো একটা সাপ্তাহিক পত্রিকাও পূনরুজ্জীবিত করে ফেলেন সাপ্তাহিকটির নাম ‘শরণী এই সাপ্তাহিকের নির্বাহী সম্পাদক করা হয় আমাকে সম্পাদক থাকেন টোকন ভাই দুজনের নামই প্রিন্টার্স লাইনে ছাপা হতে লাগলো প্রকশনা শুরু হতেই শরণীর সার্ক্যুলেশন প্রতি সপ্তাহে ৩০ থেকে ৪০ হাজারের মত হয়ে গেল

এই সময়ের কাজগুলোর কথা খুব মনে পড়ে আমাকে একসঙ্গে অনেকগুলো কাজ করতে হতো উত্তরবার্তার প্রথম পাতা এবং পেছনের পাতার প্রায় সব সংবাদই সম্পাদনা করালীড নিউজসহ বড় হেডিংয়ের অনেকগুলো নিউজ লেখাসপ্তাহে অন্তত তিনটি করে উপ-সম্পাদকীয় লেখাএগুলো সবই ছিল আমার কাজ টোকন ভাই এবং ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুহম্মদ আবদুল মতীন কোন কারণে অফিসে আসতে না পারলে সম্পাদকীয়টাও আমাকে লিখতে হতো পেজ মেকাপের কাজটিও বেশিরভাগ সময় আমাকেই করতে হতো এটা গেল উত্তরবার্তার বিষয় শরণীর জন্য গোটাটাই করতে হতো আমাকে টোকন ভাই শুধু চূড়ান্তটা দেখে দিতেন আবার তিনি ঢাকায় থাকলে আমাকেই পুরোটা দেখে দিতে হতো সে যাই হোকএই শরণীর চমক লাগানো হেডিং করাসেই হেডিংয়ের অন্তত ১৫/২০টি প্রতিবেদন লেখাএর সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখা ইত্যাদি সবই একা হাতে করতে হতো আর দৈনিক এবং সপ্তাহিকে ইরাকের বিটটা ছিল পুরো আমার উপর বিবিসিভয়েস অব আমেরিকাডয়চে ভেলেরেডিও মস্কোরেডিও বেইজিংআকাশবাণীসহ যতো রেডিও আছেতার সবই আমাকে মনিটর করে প্রতিদিনের নিউজ লিখতে হতো এক কথায় হাতমাথাশরীরমন-প্রাণ সবকিছু মিলে ছিল শুধু লেখা আর লেখা কী করে যে তখন এতোকিছু করেছিতা আজ ভাবলে নিজেই অবাক হয়ে যাই

ইরাকের নিউজ লিখতে লিখতে এমন হয়ে গিয়েছিল যেইরাকের কোথায় কি আছেকোন জায়গার কোন্ নামকোথায় কোন্ পথসাদ্দামের সহযোগী কে কেসেনা বাহিনীর হাতে কি কি সমরাস্ত্র আছেকোন সমরাস্ত্র কীভাবে ব্যবহার করতে হয়ইত্যাদি সবকিছু নখদর্পনে এসে গিয়েছিল অর্থাৎ নিজে একটি ‘ইরাকী ব্যাংক’ বা রোবট হয়ে গিয়েছিলাম শুধু ইরাক কেনপ্রতিপক্ষের বিষয়েও একই নখদর্পন অবস্থা ছিল

এখানে একদিনের একটা ঘটনা বলি রেডিও মনিটরের পর রাতে লিড নিউজ লিখছিলাম এটা ছিল এইদিনে উপসাগর যুদ্ধের সর্বশেষ তথ্য সম্বলিত খবর আমি যখন প্রতিবেদনটি লিখছিঠিক তখনই টোকন ভাইয়ের এক বন্ধুযিনি সামরিক বাহিনীর একজন মেজর অথবা তারও উপরের পদের অফিসারবগুড়া ক্যান্টনমেন্টে থাকেনতিনি অন্যান্য দিনের মত অফিসে ঢুকেই নিউজ রুম দেখতে এলেন এসে তিনি বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আমার লেখার দিকে তাকিয়ে রইলেন আমি দ্রুত লিখে যাচ্ছিলামএদিন মার্কিন বহুজাতিক বাহিনী কোথায় কোথায় কিভাবে হামলা চালিয়েছেকোথায় কোথায় বোমা ফেলেছেকী কী সমরাস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছেহামলায় কতোজন হতাহত এবং কি রকম ক্ষয়ক্ষতি হয়েছেইত্যাদি অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম কোথায় কোথায় অবস্থান করে কি কি কথা বলেছেনকিভাবে বহুজাতিক হামলার পাল্টা জবাব দিয়েছেন এবং এতে কতোজন মার্কিন সেনা হতাহত হয়েছেবা বহুজাতিক বাহিনীর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা হয়েছেতা উল্লেখ করছিলাম আন্তর্জাতিক নেতাদের নানা বক্তব্যও তুলে ধরছিলাম লেখার সময় কাছে কোন রেডিও বা এমন কোন যন্ত্রপাতি ছিল নাযা থেকে শুনে শুনে লেখা যায় সামরিক অফিসারটি ছিলেন ডিজিএফআইয়ের সঙ্গে যুক্ত তারা অত্যাধুনিক নানা যন্ত্রপাতি নিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন কিন্তু আমি কীভাবে কোন যন্ত্রপাতি ছাড়া দিব্বি উপসাগর যুদ্ধের খবর লিখে যাচ্ছি কম্পিউটারের মততা তিনি কিছুতেই ঠাহর করতে পারছিলেন না হা করে দাঁড়িয়ে থেকে তিনি টোকন ভাইয়ের রুমে গিয়েই প্রশ্ন শুরু করেনকীভাবে আমি এসব লিখছি এবং খবর পাচ্ছি টোকন ভাইও জোক করার মত চুপ করে থেকে মিটি মিটি হাসছিলেন হতভম্ব সেনা কর্মকর্তা ততোই ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ছিলেন পরে টোকন ভাই তাকে বুঝিয়ে বলেছিলেনএগুলো রেডিও থেকে শুনে মাথায় রেখে লেখা তৈরি করতে হয় সেনা অফিসার চলে যাবার পর হাসতে হাসতে টোকন ভাই বেরিয়ে এসে কথাগুলো জানিয়েছিলেন

উপসাগর যুদ্ধ চলেছিল প্রায় পাঁচ মাস পাঠকের চাহিদা বিবেচনা করে এরইমধ্যে উত্তরবার্তা সম্পাদক আরেকটি সাপ্তাহিকের ডিক্লারেশন বের করে ফেলেন এটির ঠিকানা রাখা হয়েছিল ঢাকার কিন্তু ছাপা শুরু করা হয় বগুড়া থেকে সাপ্তাহিকটির নাম ‘পূর্বালোক এটিরও নির্বাহী সম্পাদক করা হয় আমাকেসম্পাদক-প্রকাশক থাকেন টোকন ভাই একদিক থেকে এটা সুখবর হলেও আমার জন্য বেশ কষ্টের ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় কারণ সাপ্তাহিক শরণীর ক্ষেত্রে আমাকে যে কাজগুলো করতে হচ্ছিলএটার জন্য আমাকে সে কাজই করতে হলো অর্থাৎ নিউজ বের করালেখাসম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় লেখাসহ সব আমার কাজ লিখে এতোগুলো পাতা ভর্তি করা সহজ করা নয় একটা পত্রিকা হলে তাও হতোতিন তিনটে পত্রিকা একটা মানুষের জন্য যা সত্যিই অকল্পনীয় চাপ তারপরেও কীভাবে যে দায়িত্ব পালন করে গেছিতা ভেবে আজ শুধুই বিস্মিত হই

তবে একটা কথা না বললেই নয় যেএতো দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমি শুধু সমৃদ্ধ আর সমৃদ্ধ হয়েছি এজন্য টোকন ভাইকে সাধুবাদ না জানিয়ে উপায় নেই

দৈনিক উত্তরবার্তার ধরণ ছিল অন্যান্য জাতীয় সংবাদপত্রের মতোই কিন্তু শরণী আর পূর্বালোকের ধরণ ছিল সম্পূর্ণ আলাদা দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মওলানা ভাসানীর ‘হক কথা’ নামের যে সংবাদপত্রটি ছিলএই দুই সাপ্তাহিকের ধরণ ছিল সেই রকম চমকপ্রদ শিরোনাম এবং খবর ছিল এই সংবাদপত্রের প্রধান বিষয় কিন্তু এক বগুড়ায় আর কতো চমকপ্রদ সংবাদ হতে পারেঅসম্ভব ব্যাপার তাই এরসঙ্গে যুক্ত করে ফেলতে হয় আন্তর্জাতিকতাবাদকে যেহেতু উপসাগর যুদ্ধ ছিলইতারসঙ্গে যুক্ত করা হয় বিশ্বের অন্যান্য ঘটনাও বলা যায় এরকম সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বাংলাদেশে এটাই প্রথম কারণ এই ধাঁচে কোন সাপ্তাহিক সংবাদপত্র বের হয়নি কখনও

আন্তর্জাতিকতাবাদ যুক্ত হওয়ায় চমকপ্রদ খবরের অভাব হয়নি ব্যক্তিগতভাবে আমার নীতি ছিল (এমনকি টোকনই ভাইয়েরওকোন বানোয়াটমিথ্যাগসিপ নিউজ না লেখা সুতরাং সত্যিকারের সংবাদ প্রকাশ করতে হলে নখদর্পনে রাখার বিষয় ছিল গোটা বিশ্বকে যেহেতু আমাকেই সব করতে হতোতাই আস্তে আস্তে হয়ে উঠি বিশ্ব সম্পর্কে সবজান্তা কোন দেশের রাষ্ট্র প্রধানসরকার প্রধান বা তাদের হর্তাকর্তারাকিংবা সেনাপ্রধানবিশ্ব কূটনীতিকরা কোথায় কি করছেনতা আমার পক্ষে বলে দেওয়া ছিল মুহূর্তের ব্যাপার এমনকি বিশ্ব কূটনীতি কোন পথে চলছে বা চলতে যাচ্ছেতাও আমি বলে দিতে পারতাম আমাকে যদি ওই সময় বিশ্বের যে কোন পরিস্থিতি বা যে কোন দেশ সম্পর্কে বলতে বলা হতোতাহলে অনেক গবেষককেই হার মানতে হতো এটা নিঃসন্দেহে একজন সাংবাদিকের জন্য বিশাল ব্যাপার ছিল

এই আন্তর্জাতিকতাবাদ সম্পর্কে জানার পেছনে ছোট বয়সের আরও কিছু ঘটনা আছে তখন বাম রাজনীতি করতাম শুধু করতাম বললে ভুল হবেরীতিমত রাজনৈতিক প্রশিক্ষকের দায়িত্বও পালন করতে হয়েছে স্বাভাবিকভাবেই দেশ-বিদেশের অনেক কিছু জানা থাকতে হতো কিন্তু সব জায়গায় মাতব্বরি করে এলেও ধরা খেয়ে যেতাম একজনের কাছে সে হলো এক ভাগ্নেডাক নাম কচি  সেভেন-এইটে পড়াশুনা করতো রাজশাহী ক্যাডেট স্কুল এন্ড কলেজে ওর কাজ ছিলে খুঁটে খুঁটে বিভিন্ন সংবাদপত্রের আন্তর্জাতিক পাতা পড়া এভাবে পড়তে গিয়ে  আন্তর্জাতিক ঘটনা সম্পর্কে বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠেছিল ফলে ওর সামনে যখন কোন আলোচনায় আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে কথা বলতামতখন দেখতাম  খুক খুক করে হাসছে পরে এর কারণ জিজ্ঞাসা করতেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিতোকী কী ভুল-ভাল বলেছি তখন লজ্জায় মরে যেতাম সে কারণে আমিপাঞ্জাব আলী বিশ্বাস (সাবেক সংসদ সদস্য), তোসলিম হাসান সুমন (পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক ভিপি), গোলাম মোস্তফা তারা (পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের সাবেক জিএসসহ সব ছাত্র নেতারাই ওর সামনে আন্তর্জাতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে যেতাম না তবে তলে তলে আমিও সংবাদপত্র পড়ে আন্তর্জাতিক বিষয় সম্পর্কে আপডেট থাকার চেষ্টা করতাম

 

------ চলবে ------


  

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

 

এগারো.

আগেই বলেছিআন্তর্জাতিক খবরকে ভিত্তি করে বগুড়ার মত মফস্বল শহর থেকে সংবাদপত্র বের করা ছিল বিরল ঘটনা এটা বিরল আরও কতগুলো কারণে তারমধ্যে একটি হলো এর পাঠকপ্রিয়তা এবং প্রচার যেমনসাপ্তাহিক শরণীর সার্কুলেশন উঠে গিয়েছিল প্রায় ৫০ হাজারে আর সাপ্তাহিক পূর্বালোক-এর সার্কুলেশন ছিল ২০ হাজারের মত বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের পাঠকরা বিদেশি সংবাদ নির্ভর এই দুটি সংবাদপত্রকে প্রত্যাখান না করে উল্টোটা করেছেন তারা বিদেশি সংবাদ  ঘটনা প্রবাহের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন তাঁদের জ্ঞানের ভান্ডারে যোগ হয়েছে আন্তর্জাতিক বিষয়গুলো বিশ্বায়নের যুগে এটাকে কোন অবস্থাতেই খাটো করে দেখার ছিল না আসলে সব মিলিয়ে সাংবাদিকতার দিক থেকে এটা ছিল সত্যিকারের সাফল্য এই সাফল্যের জন্য যেমন সাপ্তাহিক দুটির সম্পাদক-প্রকাশক মাহবুব উল আলম টোকন ভাই ধন্যতেমনই এরসঙ্গে যুক্ত থেকে এবং অবিরাম কাজ করে নিজেকেও ধন্য  গর্বিত মনে করি

সার্কুলেশনের বাইরে অরেকটি কথাও বলতে হয় কারণ  দিকটাকে বাদ রাখলে আসল বিষয়টিই চাপা পড়ে যায় এই দিকটা হলোদুটি সাপ্তাহিকেরই একটি রাজনৈতিক দর্শন ছিললক্ষ্য ছিল তা হলোমানুষকে সাম্রাজ্যবাদ-পুঁজিবাদ-আগ্রাসনবাদ-সাম্প্রদায়িকতা-ধর্মান্ধতা-কুসংস্কারবিরোধী চেতনায় ধাবিত করা তাঁদের গণতন্ত্র  প্রগতিশীলতার লক্ষ্যে ধাবিত করা এরকম লক্ষ্যকে সামনে রেখে কাজ করার পেছনে নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ছিল গুরুত্বপূর্ণ যেমন সম্পাদক মাহবুব উল আলম টোকন এক সময় বামপন্থী রাজনীতি করতেন দীর্ঘদিন আন্ডারগ্রাউন্ডও থেকেছেন তাঁর খালুযিনি দৈনিক উত্তরবার্তার ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক মুহম্মদ আবদুল মতীনতিনি ব্রিটিশ-ভারত কমিউনিস্ট পার্টির গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা এবং সংগঠক হিসেবে কাজ করেছেন আমাদের ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন সব মিলে তিনি একজন কমিউনিস্ট মনোভাবাপন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন সাংবাদিকতার জীবনেও দৈনিক উত্তরবার্তাশরণীপূর্বালোকের কাজ একই অফিস বা ঘর থেকে হতো বলে আমাদের একাত্মতা ছিল একাকার নিজেও ওই রকম আদর্শের লোক ফলে কাজ করায় কোন সমস্যা ছিল না তবে এমন দর্শন  লক্ষ্যকে এগিয়ে নিতে যে আমাদের পথ মসৃন ছিলতা নয় নানা বাধা-বিপত্তি এবং প্রতিবন্ধকতার মুখে তখন আমাদের সাংবাদিকতা করতে হয়েছে কারণ দেশে সত্যিকারের গণতন্ত্র ছিল না রাষ্ট্রীয়ভাবে ছিল না প্রগতিশীলতা বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সে কারণে এসবের বিরুদ্ধে আমাদের রীতিমত লড়াই করতে হয়েছে

বগুড়ায় অনেকদিন থেকেছি সেই ১৯৯০ সালে গিয়েছিতারপর কেটেছে ২০০৩ সাল পর্যন্ত অর্থাৎ এক যুগ পার কোথাও এক যুগ বাস করলেই নাকি সেখানকার নাগরিকমানে সেটা জন্মভূমি হয়ে যায় এই অর্থে বগুড়া আমার জন্মস্থান হয়ে গিয়েছিল গিয়েছিল বলা ভুল বগুড়া জন্মস্থান হয়ে গেছেহয়ে আছে এবং থাকবে  কথাটা এজন্যই বলছি যেবগুড়াকে এতোটাই ভালবেশে ফেলেছিযাতে করে আমার প্রথম জন্মস্থান বেশ খানিকটা গৌনই হয়ে গেছে এমন ভালবাসা জন্মে যাওয়ার কারণ বগুড়ার মানুষের ভালবাসাসাংবাদিক বন্ধুদের ভালবাসা

এক কথায় বলতে হয়বগুড়ায় সাংবাদিক সহযোদ্ধা হিসেবে যাঁদের সবসময় সব কাজে পেয়েছিতাঁরা সবাই ছিলেন আদর্শ চিন্তার মানুষসৎনির্ভীকপ্রগতিশীল এবং সব ধরনের অন্যায়-অবিচার-অনিয়মের বিরোধী চেতনার সে কারণে যাহেদুর রহমান যাদুসমুদ্র হকপ্রদীপ ভট্টাচার্য শঙ্করআকতারুজ্জামান আকতারমাহমুদুর রহমান মনারবিউল ইসলামমিলন রহমানমাহমুদুল আলম নয়নআরিফ রেহমানআমজাদ হোসেন মিণ্টুআবুল কালাম আজাদ ঠান্ডাশফিউল আযম কমলচপল সাহারেজাউল হাসান রানুআবদুল মোতালিব মানিককমলেশ মোহন্ত সানু, সাইফুল বারি ডাবলুফটো সাংবাদিক বিমুবিনয় কুমার দাসসহ অনেককে কোনদিন ভুলবার নয় তাঁরা এক একজন পথিকৃৎ সাংবাদিক তাঁদের সততানিষ্ঠা এবং মহানুভবতার তুলনা হয় না

বগুড়ায় সম্পাদক বা সংবাদপত্রের জগতকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য বেশ কয়েকজনের অবদান এবং কৃতিত্ব স্মরণীয় দুর্গাদাস মুখার্জীর কথা আগেই বলেছি মুহম্মদ আবদুল মতীনমাহবুব উল আলমের কথাও বলেছি এখানে উল্লেখ করতে হয় যেবগুড়ায় পুরনো সংবাদপত্রের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোদৈনিক বাংলাদেশ এর সম্পাদক আমান উল্লাহ খান শুধু প্রবীণ সাংবাদিক-সম্পাদকই ননতিনি বরেণ্য রাজনীতিবিদও ভাবগাম্ভিয্যের এই মানুষটি মানুষ হিসেবে খুবই অমায়িক আমার সঙ্গে সবারই সুসম্পর্ক ছিল তাঁর সঙ্গেও ছিল তিনি বগুড়ার প্রাণকেন্দ্র সাতমাথা থেকে সামান্য এগিয়ে হাসপাতাল রোডের পাশে অফিস ঘর থেকে পত্রিকার দায়িত্ব পালন করতেন

দৈনিক উত্তরবার্তা ছাড়াও আমি কাজ করেছি দৈনিক করতোয়ায় এই দৈনিকটি এক পর্যায়ে স্থানীয় এবং জাতীয় সব সংবাদপত্রকে ছাড়িয়ে গোটা উত্তরাঞ্চলে এক চেটিয়া মার্কেট পেয়ে যায় সার্কুলেশন লাখেরও অনেক উপরে চলে যায় বগুড়া থেকে আধুনিক মেশিনে ছাপানো কালার্ড সংবাদপত্র এটিই প্রথম এক পর্যায়ে এটি রাজধানীর বাজারেও অবস্থান গড়ে তোলে অন্তত বছর তিনেকের মতো এই সংবাদপত্রে বার্তা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে তারপর ঢাকা চলে আসি করতোয়া সম্পর্কে বলতে গেলেপ্রথমেই স্মরণ করতে হয় সংবাদপত্রটির প্রকাশক-সম্পাদক মোজাম্মেল হক লালু ভাইকে তিনি কী অপরিসীম চেষ্টাপ্রজ্ঞা এবং আধুনিক চিন্তাধারায় তাঁর নেতৃত্বাধীন করতোয়াকে সুপ্রতিষ্ঠিত করে অগ্রগতির পর অগ্রগতির পথে নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকতার শীর্ষে উঠিয়েছেনতা কল্পনাই করা যায় না এই করতোয়া কিন্তু দেশের গোটা উত্তরাঞ্চলে ওই সময়ের 'ইত্তেফাক বলে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল এখন এর আরও প্রসার ঘটেছে সুতরাং করতোয়াকে মফস্বল সংবাদপত্রের মাইলফলক বলা যায় ব্যক্তিগতভাবে লালু ভাই অত্যন্ত সহজসরল এবং সমাজসেবী মানুষ যদিও তিনি তাঁর সরলতার জন্য অনেক সময়ই বিভিন্ন রকম অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন কিছু মানুষ থাকে যারা কানকথা দিয়ে স্বার্থ হাসিল করে থাকে লালু ভাই সরলতা এবং সহজ বিশ্বাসের কারণে এদের দ্বারা অনেক সময়ই বিভ্রান্ত হয়েছেন তবে  থেকে তিনি বেরিয়ে আসার প্রমাণও রেখেছেন

বগুড়ায় আরও কতগুলো সংবাদপত্র জনপ্রিয় ছিল এগুলো হলো মাকসুদার রহমান খুকু কর্তৃক প্রকাশিত দৈনিক চাঁদনী বাজার সুপরিচিত মুকুল প্রেস থেকে এটি বের করা হতো পুরনো সংবাদপত্রের মধ্যে আরেকটি হলো দৈনিক মুক্তবার্তা এটি বগুড়ার বিশিষ্ট সাংবাদিক ওয়াসিকুর রহমান বেচান তাঁর সম্পাদনায় বের করতেন যদিও বেচান ভাই বগুড়ার সংবাদপত্র জগতের অন্যতম শ্রষ্টাকিন্তু আর্থিক সংকটের কারণে তাঁকে অনেক সময়ই থমকে দাঁড়াতে হয়েছে  সময় বগুড়া থেকে প্রকাশিত জনপ্রিয় আরও তিনটি সংবাদপত্র হলো দৈনিক দুর্জয় বাংলাদৈনিক আজ  আগামীকাল এবং দৈনিক সাতমাথা আমি বগুড়ায় থাকার সময় মূলত এগুলোই ছিল মূল সংবাদপত্র

সাংবাদিকতা এবং রিপোটিং নিয়ে দুটো কথা বলতেই হয় যেমন আমি পদবী অনুযায়ী সম্পাদকের অবস্থানে থাকলেও কার্যত রিপোর্টিংটা সব সময়ই ছিল কারণ স্থানীয় এসব সংবাদপত্রের ধরণ ছিলযিনি সম্পাদক বা সম্পাদনার বিভাগে দায়িত্ব পালন করেনতাঁকে প্রেসরিলিজ লেখা-দেখারিপোর্টিংএডিটিংগেটআপ-মেকআপ সবকিছুই করতে হতো অর্থাৎ একের মধ্যে থাকতে হতো সবকিছু আমাদের সবারই সেটা ছিল সুতরাং আমি রিপোর্টার জীবনের টুকিটাকি বলতে গিয়ে কাজ দেখালাম সম্পাদনায়তা কিন্তু নয় তাছাড়া আর্থিক সংকটের কারণে এক পর্যায়ে আমাকে বগুড়ার সংবাদপত্রে সম্পাদনা বিভাগে দায়িত্ব পালন করলেও শুধু রিপোর্টিংয়ের জন্য রাজধানীর সংবাদপত্রেও কাজ করতে হয়েছে যেমন ওই সময় দৈনিক মাতৃভূমির উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে যদিও রিপোটিংয়ের পাশাপাশি  সংবাদপত্রে বিশেষ কলামও লিখতে হয়েছেযা ছাপা হয়েছে প্রথম পৃষ্ঠায় বিশেষ মর্যাদা দিয়ে

মাতৃভূমি সম্পর্কে একটি কথা না বললেই নয় এরজন্য গভীর কৃতজ্ঞার সঙ্গে স্মরণ করতে হয় সম্পাদক বিভুরঞ্জন সরকারকে তিনি না থাকলে সম্ভবত আমার আর্থিক ভাগ্য সুসম্পন্ন হতো না তিনি আমাকে বগুড়ায় থেকে গোটা উত্তরাঞ্চলের জন্য 'উত্তরাঞ্চলীয় প্রতিনিধি হিসেবে শুধু নিযোগপত্রই দেননিপ্রতি মাসে সম্মানী বা বেতন হিসেবে পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন বিভিন্ন ট্যুর এবং ছবিসহ অন্যান্য খরচের টাকা আলাদাভাবে দেওয়ারও ব্যবস্থা করেছিলেন বগুড়ার দৈনিক  দুই সাপ্তাহিক মিলে তখন আমার বেতন ছিল তিন হাজারেরও নীচে সেখানে এই পাঁচ হাজার টাকা যোগ হওয়া এবং এরসঙ্গে অন্যান্য খরচ মেলায় সত্যিই আমার ভাগ্য ফিরেছিল বিভুদা যতোদিন ছিলেন ততোদিন এভাবেই টাকা পেয়েছি তারপর তিনি যখন থাকতে পারলেন নাতখন এটা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল অবশ্য এরপর বিভুদা একটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন সেটিতেও তিনি লেখা বাবদ সম্মানী দেওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন তিনি যে কতোখানি সৎনির্লোভএকনিষ্ঠআন্তরিকউদার মনের মানুষ এবং বড় মাপের অভিজ্ঞ সাংবাদিকতা তাঁর প্রতিটি কর্মে তখন বুঝতে পেরেছি তিনিও অনেক দুঃসময় পার করেছেনকিন্তু কখনও হার মানেননি

সবশেষে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই সেটা হলো সৎ এবং সততার সাংবাদিকতার বিষয় এটা বগুড়ায় পুরোদমে ছিল কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে এর বেশ খানিকটা ব্যত্যয় ঘটে আর সেটার কারণ বগুড়ার সাংবাদিক বা সংবাদপত্র নয় কারণ বাইরের একজন নীতিহীন সাংবাদিক যাকে ঢাকা থেকে একটি সংবাদপত্রের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়েছিল নাম উল্লেখ করতে চাই নাতবে তাকে ঢাকায় অনেকে মদন বলে চেনেন সেই মদন বগুড়ায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে সাংবাদিকতায় ধান্ধাবাজি এবং  থেকে স্বার্থ হাসিলের উপায়গুলো অনেককে চিনিয়ে দেন চেনানোদেরকে সেই পথে নামিয়ে দেন এভাবে  থেকে তিনি যেমন লাভবান হয়েছেনতেমন ক্ষতি করেছেন বগুড়ার সাংবাদিকতাকে কিন্তু সত্যিকারের সাংবাদিকদের জোড়ালো অবস্থান ছিল বা আছে বলেই বগুড়ার সাংবাদিকতা লড়াই করে সব সময় সঠিক পথে থাকতে পেরেছে

---------- চলবে ----------


রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

-        আবুল হোসেন খোকন

সাংবাদিকতা করতে আমার ঢাকায় আগমন ২০০৫ সালে  সময় এদিক-ওদিক লেখালেখি করছিলাম অর্থাৎ কলাম লিখছিলাম আজকের কাগজদৈনিক সংবাদভোরের কাগজজনকণ্ঠসমকাল ছাড়াও বেশ কয়েকটি সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে লিখছিলাম এরমধ্যে নিয়মিত পয়সা পাচ্ছিলাম আজকের কাগজ থেকে এছাড়া সাপ্তাহিকগুলোও একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ সম্মানী দিচ্ছিল এইসব করার ভেতর দিয়ে কোন সংবাদপত্রে নিয়মিত চাকরি খোঁজার কাজটিও চলছিল চাকরি না পাওয়া পর্যন্ত কাজ করছিলাম একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির বেশকিছু প্রকাশনা এবং তাদের মুখপত্র 'জাগরণ সম্পাদনায় বেসরকারি সংস্থা 'নিজেরা করি তেও রিপোর্ট বিভাগে কাজ করেছি এক পর্যায়ে চাকরির ব্যাবস্থা হয়ে গেল দৈনিক আমাদের সময়- এর সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান আমাকে উপ-বার্তা সম্পাদক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় এটা ২০০৫ সালের শেষ দিকের ঘটনা

ভালই লাগছিল মোটামুটি একটা নির্দিষ্ট পরিমান বেতন পাচ্ছিলাম নাঈম ভাই নিজেও আমাকে খুব ভাল চোখে দেখছিলেন আর বার্তা সম্পাদক হিসেবে পেয়েছিলাম জহিরুল আহসান টিপু ভাইকে অসাধারণ মানুষ ছিলেন তিনি খুব ভাল লেগেছে তাঁকে

এখানে একটা কথা না বললেই নয় সেটা হলোআমাদের সময়- চাকরিটা জোগার করে দিয়েছিলেন আজকের কাগজের উপসম্পাদকীয় পাতার দায়িত্বে থাকা সালাম সালেহ উদদীন ভাই তিনি অসাধারণ ভাল মানুষ নিয়মিত কলাম লেখার সুবাদে তাঁকে জানিয়েছিলামআমার চাকরির দরকার তিনি তখন নাঈম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে আমার ব্যবস্থাটা করেছিলেন

যাই হোকভাল কাটছিল সময় একেবারে নির্দিষ্ট তারিখে বেতন না পেলেও মাসের মধ্যে সেটা মিলছিল রাতে গাড়ি দিয়ে বাসায় পৌছে দেওয়া হচ্ছিল

কিন্তু বেশিদিন এবাবে চলেনি হঠাৎ মালিক পক্ষের সঙ্গে নাঈম ভাইয়ের কী একটা সমস্যা তৈরি হলো তখন তিনি বার্তা সম্পাদক টিপু ভাইকে অন্য কোথাও চলে যেতে পরামর্শ দিলেন এরপর টিপু ভাই ভোরের কাগজে ঢুকে পড়লেন বার্তা বিভাগে নতুন কোন নিয়োগ দেওয়া হলো না এরইমধ্যে সবার বেতন আটকে গেল আমিসহ অন্যরা তখন অসহায়ের মত বেতন ছাড়াই মাস দেড়েক-দুয়েক কাজ করলাম সবমিলে আমাদের সময়- প্রায় দুই বছরমত কাজ করেছিলাম এক পর্যায়ে নাঈম ভাইও দায়িত্ব ছেড়ে দিলেন তখন আবার বেকার হয়ে পড়লাম

এভাবে চলতে চলতে একদিন রাজপথে দেখা জহিরুল আহসান টিপু ভাইয়ের সঙ্গে কুশল বিনিময়ের ভেতর তাঁর বিষয়-আমার বিষয় উঠে এলো তিনি জানালেনএখন দৈনিক ডেসটিনিতে বার্তা সম্পাদক হিসেবে কাজ করছেন আমার বেকারত্ব জেনে তিনি একটা তারিখ দিলেন এবং বললেনওইদিন যেন আমি বায়োডাটা নিয়ে দেখা করি তারপর গেলাম নির্দিষ্ট দিনে সেখানে সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলে তিনি আমার চাকরির ব্যবস্থা ঠিক করে ফেললেন তাঁর অধীনেই আমার পদবী হলো 'কপি এডিটর সুন্দর একটা বসার জায়গা পেলামসঙ্গী হিসেবে পেলাম আরেক কপি এডিটরকেযার সঙ্গে দৈনিক আমাদের সময়- একই রুমে কাজ করেছি তিনি হলেন কবি হুমায়ন কবির খুব ভাল মানুষ অনেক দিন চীনে থেকে এসেছেন আমাদের সময়- থাকতে থাকতেই তিনি চীনে গিয়েছিলেন তারপর সেখানে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেই টিপু ভাইয়ের দেখা পেয়ে আমারমত ডেসটিনিতে ঢুকেছেন তিনি আর আমি একই রুমে একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ পেলাম তখন সময়টা ছিল ২০০৮-এর শেষার্ধ

সুন্দর সময় কাটছিল বেতন-ভাতা নিয়ে সমস্যা ছিল না কাজও ছিল নির্দিষ্ট কপি সম্পাদনা এবং প্রয়োজন বোধে প্রথম বা শেষ পাতার মেকআপ করার দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছিল এখান থেকেও বাসায় পৌছার জন্য গাড়ি পাচ্ছিলাম সবই ভাল ছিল

কিন্তু ভাল সময়গুলো বোধহয় বেশিদিন যায় না বিশেষ করে আমার বেলায় এটা বোধহয় নিয়তি যদিও এসবে বিশ্বাসী নইতারপরেও ঘটনা ঘটনাই কোন কারণে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে টিপু ভাইয়ের সম্পর্কের অবনতি ঘটলো তারপর হঠাৎ করেই তিনি পদত্যাগ করে আবার ভোরের কাগজে চলে গেলেন এরপর বার্তা সম্পাদকের পদে এলেন নিজেক 'বিশাল কিছু মনে করা এক দাম্ভিক বিএনপির মুখপত্র দৈনিক দিনকাল থেকে তিনি আসেন এসে এমনকিছু ভূমিকা নেনযার কারণে আমাদের বেশ কয়েকজনের এখানে টিকে থাকা কঠিন হয়ে দাঁড়ালো সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম পদত্যাগ করবো সে অনুযায়ীপদত্যাগ করেও ফেললাম পরে জেনেছিলাম যার কারণে পদত্যাগ তিনিও বেশিদিন ওই কাগজে টিকতে পারেননি তাকে অব্যহতি দেওয়া হয়

এরপরে যেটা ঘটলো সেটা অনেকটা অপ্রত্যাশিত হলেওছিল বহুল আকাঙ্ক্ষিত হঠাৎ করেই দৈনিক সংবাদ-এর সহকারী সম্পাদক (তিনি সম্পাদকীয়-উপসম্পাদকীয় পাতার মূল দায়িত্বে ছিলেনমুনীরুজ্জামান ভাই মোবাইলে মেসেজ দিয়ে জরুরি ভিত্তিতে দেখা করতে বললেন তার আগে থেকে আমি নিয়মিত দৈনিক সংবাদ- কলাম লিখতাম সেই সুবাদে তাঁরসঙ্গে সুসম্পর্ক

জরুরি ভিত্তিতেই আমি তাঁরসঙ্গে দেখা করলাম এরপর জানলাম তিনি দৈনিক সংবাদ-এর ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হয়েছেন সদ্য আমাকে তাঁর দক্ষিণহস্ত হিসেবে প্রয়োজন কোন প্রশ্ন না করে তিনি দৈনিক সংবাদ- যুক্ত হতে বললেন বলা যায়তিনি আমার কোন কথাই শুনলেন না, 'আজ থেকে যুক্ত হলাম বলে লিখিত নিয়ে নিলেন কোন পদে কতো বেতনেইত্যাদি কোন প্রশ্নই তিনি করতে দিলেন না আমার জন্য অবশ্য একটা চাকরি জরুরি ছিল এবং দৈনিক সংবাদ ছিল আমার সবচেয়ে ভক্তি এবং পছন্দের সংবাদপত্র কারণ এখানে যাঁরা কাজ করেনতাঁরা সবাই আমার চিন্তাধারার সুতরাং বিনা শর্তে মুনির ভাইয়ের প্রস্তাব লুফে নিলাম এবং পরদিন থেকেই কাজে যোগ দিয়ে দিলাম

বেতন ঠিক হয়ে গেল কিন্তু কী পদে কাজ করবোতা নির্ধারণ করতে বেশ কিছুদিন সময় লেগে গেল আপাতত বার্তা বিভাগের দেখাশুনাতারপরে চূড়ান্ত হলো দায়িত্ব মুনির ভাই জানালেনএকজন বার্তা সম্পাদক নেওয়ার কাজ চলছেন্যাশনাল ডেস্ক দেখার কেও নেই এই ডেস্কের সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব নিলে তিনি নিশ্চিন্ত হতে পারেন কারণ অন্য কাউকে তিনি বিশ্বাস করতে পারছেন না

তখন বুঝলাম ভেতরে ভেতরে বড় রকমের ঘটনা ঘটে গেছে গুরুত্বপূর্ণ অনেকেই সংবাদ ছেড়েছেনআরও অনেকে ছাড়তে যাচ্ছেন এমনকি শ্রদ্ধেয় মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ভাইও অফিস ছেড়েছেন এই অবস্থায় সব দায়িত্ব নিতে হয়েছে মুনীর ভাইকে আর এরজন্য তিনি বিশ্বস্তদের সঙ্গে চাইছেন আমার জন্য সৌভাগের বিষয় সেটাই যেতিনি আমাকে তাঁর বিশ্বস্ত মনে করেছেন

আগেই বলেছিসংবাদ ছিল আমার স্বপ্নের জায়গা সেটা এভাবে মিলে যাবেতা স্বপ্নেও ভাবিনি আর ন্যাশনাল ডেস্ক সম্পাদকের দায়িত্ব দিয়ে মুনীর ভাই আমাকে পুরো কর্তৃত্ব দিয়ে দিলেন নিয়োগছাটাইবেতন সংক্রান্ত আলোচনাছুটি-ছাটা সমস্ত কিছু আমি করতে পারবো সব ঠিক করে মুনীর ভাইকে দিয়ে শুধু আমাকে সেটা অনুমোদন করিয়ে নিতে হবে

সুতরাং গোটা দেশের দায়িত্ব পেয়ে আমি সবকিছু ঢেলে সাজিয়ে নেওয়া শুরু করলাম প্রয়োজেন মুনীর ভাই সবরকম সহযোগিতা দিতে থাকলেন তিনি আমার উপর এতোটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন যেআমি একদিন ছুটি নিলে তাঁর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়তো বলতেনতাহলে পাতা বেরুবে কেমন করেআমি তাঁকে নিশ্চিত করেছিলামএই সংবাদের আমি এমন অবস্থা করবো যেকারও জন্য কোন কিছু ঠেকে থাকবে না সবকিছু স্বয়ংসম্পন্ন হয়ে উঠবে আমার ছুটির জন্য আপনাকে কোন রকম ভাবনায় পড়তে হবে না যাই হোকপরে আমি সেটাই করেছিলাম কিন্তু আমি সহজ-সরল এবং পরিস্কার মনের ছিলাম বলে এর নেতিবাচক দিকটি সম্পর্কে কখনই ভাবিনি যেটা আমার জন্য পরবর্তীতে কাল হয়ে দেখা দিয়েছিল

সংবাদ- আমি যুক্ত হওয়ার বেশ কয়েক মাস পর বার্তা সম্পাদকের জায়গাটি পূরণ হলো যাঁকে ভারপ্রাপ্ত বার্তা সম্পাদক হিসেবে আনা হলোতিনি আমার পূর্বপরিচিত দৈনিক মাতৃভূমিতে কাজ করার সময় তিনি ছিলেন সেখানকার বার্তা সম্পাদক তিনি হলেন কাজী রফিক খুবই যোগ্যসহজ-সরলআন্তরিক এবং নাটকে অভিনয় করা মানুষ আমার পাঠানো নিউজগুলোকে তিনি সবচেয়ে বেশি হাইলাইট করে প্রকাশ করতেন

রফিক ভাই আসায় হাউজের পরিবেশ আরও সুন্দর হলো আমার জন্যও ভাল হলো আর খারাপ যেটা হলো সেটা হচ্ছেএইসব দায়িত্বের যায়গায় চলে যাওয়ার কারণে আমার কলাম লেখার কাজটা বেশ দ্রুতই শেষ হয়ে গেল যে কলাম লেখাকে কেন্দ্র আমার পরিচয়ের জায়গাটা তৈরি হয়েছিলসেটা দিনে দিনে উধাও হয়ে গেল

 

-------- চলবে ----------


 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

কাজ শুরুর মধ্যদিয়ে বুঝলাম সংবাদের বাস্তবতা ডেস্ক পড়ে আছে মান্ধাতার আমলে সব লেখালেখির কাজ হয় হাতে লিখে সম্পাদনাও হয় লেখা কপির উপর হাতের কলম চালিয়ে এতেকরে সময় যেমন অনেক বেশি লাগেভুল সংশোধন করতেও কম্পিউটার কর্মীদের কষ্ট হয় শুধু লেখা বা সম্পাদনাই নয়সব কাজই হয় পুরনো নিয়মে অর্থাৎ ডামি করা হয় কাগজের উপর হাতে এঁকেমেকাপ কপি সাজানো হয় ট্রেসিং কেটে কেটে কস্টেপ সেঁটে এরকম যতো কাজসবই মান্ধাতার আমলের ডেস্কে কম্পিউটার আছেকিন্তু সেটার ব্যবহার জানেন কম জনই

শ্রদ্ধেয় বুলবুল ভাই যে কম্পিউটার ব্যবহার করতেন এবং যে চোয়ারে বসতেনসেটাতেই আমাকে কাজ করার জন্য বসানো হয়েছিল আমি যেহেতু কম্পিউটারে কাজ করে অভ্যস্ত এবং কোন কপিই হাতে লিখিনা বা দেখি নাসেহেতু প্রথমেই কাজটা শুরু করে দিয়েছিলাম আধুনিক নিয়মে কম্পিউটারে লেখাসম্পাদনা থেকে যাবতীয় কাজ যখন করতে লাগলাম এবং এতেকরে যখন দেখা গেলসব কাজটাই হচ্ছে কল্পনাতীত দ্রুত গতিতে একটা কপি হাতে সম্পাদনা করতে যেখানে আধাঘণ্টা লাগছেসেখানে আমার কাছে তা সম্পণœ হচ্ছে / মিনিটে কোন লেখা হাতে লিখতে যেখানে এক-দেড় ঘণ্টারও বেশি সময় লাগছেসেখানে আমার লাগছে খুব বেশি হলে ১০ মিনিট ফলে অফিসের সবাই এই ঘটনা দেখে নতুন করে ভাবনা শুরু করলেন তারাও কম্পিউটার ব্যবহার শেখা শুরু করে দিলেন এরপর দেখা গেল আমার উদ্যোগের কারণে অফিসের অর্ধেকের বেশিজন আস্তে আস্তে কম্পিউটার ব্যবহার শিখে সে-মত কাজ করা শুরু করেছেন এমনকি পেজ মেকাপের কাজটিও শেষ পর্যন্ত কম্পিউটারাইজড হয়ে যায় বলা যায়এতে করে সংবাদের সংবাদ বিভাগ মান্ধাতার আমল থেকে আধুনিক যুগে প্রবেশ করলো আমার উদ্যোগটা না থাকলে বোধহয় সংবাদকে এই জায়গায় পৌছাতে আরও অনেকদিন অপেক্ষা করতে হতো

আমাকে আরেকটা কাজ করতে বলা হয়েছিল সেটা হলোন্যাশনাল ডেস্কের সার্কেলকে সুশৃঙ্খল অবস্থায় নিয়ে আসা ডেস্কের প্রধান হিসেবে আমার জন্য কাজ ছিলগোটা দেশের প্রতিনিধিদেরকে কাজে-কর্মের জন্য ঢেলে সাজানো কাজটা মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই সম্পণœ করে ফেলেছিলাম প্রত্যেক জায়গার প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলে তাঁদের অবস্থাসমস্যা এবং অন্যান্য বিষয় জেনে সেইমত যতোদূর সম্ভব ব্যবস্থা নিয়ে ফেললাম আমি যেহেতু রাজনীতি-সংস্কৃতি এবং সংগঠনের সাংগঠনিক কাজ করা লোকসেহেতু এগুলো ঠিক করা কঠিন কোন বিষয় ছিল না এই কাজগুলো করতে গিয়ে সব জায়গার প্রতিনিধিদের সঙ্গে গভীর আন্তরিকতা গড়ে উঠেছিল তাঁদের সমস্যাদুঃখদূর্দশা দূর করতে আমি হয়ে উঠেছিলাম মধ্যমনি মুনীর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের বিষয়গুলোর সমাধান টানছিলাম কোথাও কোথাও কিছু অনিয়ম বা কাজকর্ম সম্পর্কে অভিযোগ ছিল সেইসব জায়গার প্রতিনিধি পরিবর্তন করে ভাল সাংবাদিককে নিয়োগ দিয়ে ন্যাশনাল ডেস্ক সার্কেলকে একটি সুসংগঠিত সার্কেলে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলাম অর্থাৎ নীচ থেকে উপর পর্যন্ত স্বচ্ছতা এবং দুর্নীতিমুক্ত অবস্থা তৈরি করা সম্ভব হয়েছিল

মুনীর ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলে ডেস্কেও একটা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন এনেছিলাম আগে এই ডেস্কের কাজ শুরু হতো বিকেল থেকে চলতো রাত ১০টা পর্যন্ত এটার পরিবর্তন আনা হয় এইভাবে যেকাজ শুরু হবে সকাল থেকে এবং শেষ হবে বিকেলে বিকেলের পর কাজ শুরু করবে সেন্ট্রাল ডেস্ক এরফলে আগে যেমন ন্যাশনাল ডেস্কের মেকাপ শেষ হতো রাত সাড়ে ১০টা১১টার দিকেএখন সেটা শেষ হচ্ছে বিকেল ৫টার মধ্যে রাতে কোন বড় ঘটনা থাকলে সেটা দেখার দায়িত্ব সেন্ট্রাল ডেস্কের এই ব্যবস্থাপনায় চলে আসায় কাজ যেমন দ্রুত এবং সময়মত শেষ হচ্ছিলমূল কাগজ বের হতেও আর ভোর ৪টা বাজার ব্যাপার থাকেনি রাত ১টার মধ্যেই কাগজ প্রেস থেকে চলে যেতে থাকলো

এরকম একটা ব্যবস্থাপনার কারণে ডেস্কের কাজেও যেমন সুন্দর একটা সিস্টেম ফিরে এসেছিলন্যাশনাল ডেস্কের নেটওয়ার্ক কর্মেও আমূল পরিবর্তন এসে গিয়েছিল প্রতিনিধিরা তাঁদের প্রতিবেদনগুলো দুপুরের আগেই দিয়ে দিতেনআর তাৎক্ষণিক প্রতিবেদনগুলো ৩টা-সাড়ে ৩টার মধ্যে দিয়ে দিচ্ছিলেন পরের ঘটনাগুলো যাচ্ছিল সেন্ট্রাল ডেস্কের হাতে

আমাকে ব্যবস্থাপনাটা এমন একটা জায়গায় নিয়ে যেতে সমস্যায় যে পড়তে হয়নিতা নয় পড়তে হয়েছে কারণ সব জায়গায়ই  Ô-কাজের লোকদের অবস্থান ঠিক রাখতে Ôষড়যন্ত্রমূলক ভূমিকা থাকে এটা যেমন সংসারে থাকেসমাজে থাকেরাষ্ট্রে থাকেতেমন সংবাদেও ছিল এই Ô-কাজের লোকদের কাজ ছিলসকাল সকাল অফিসে এসে মুনীর ভাইয়ের Ôকানভারী করা তারা এটা করতেনআর ধৈর্য ধরতেন অপেক্ষা করতেনমুনীর ভাই তাদের কথা রাখেন কিনা কিন্তু মুনীর ভাই তাদের কথা শুনতেনসেইমত কাজ করতেন খুব কম যে কারণে আমার পক্ষে সামনে এগুনো সমস্যা হয়নি তবে সমস্যাটা তৈরি হয়েছিল আরেক জায়গায় সেটা পরবর্তীতে তুলে ধরবো

এখানে একটা কথা না বললেই নয় যেভাল কাজ চাইলে ভাল খাদ্যেরও যোগান দিতে হয় কিন্তু এই জায়গাটায় ছিল কর্তৃপক্ষের চরম অবহেলা বা অনিচ্ছা কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে ভাল কাজ চাইতেনকিন্তু বেতন-ভাতার বেলায় থাকতেন উল্টো অবস্থানে এটা কারও অজানা নয় যেসংবাদে একজন সাব এডিটরকে যে বেতন দেওয়া হয়তা ফুটপাতের ঝাড়ুদারের চেয়েও কয়েকগুন কম আমাকে ২৭ হাজারের উপরে বেতন দেওয়া হবে বলে উল্লেখ করা হলেও বাস্তবে তা পাইনি নিয়োগপত্র দিতে চেয়ে পর্যন্ত দেওয়া হয়নি আমার বেতন দেওয়া হচ্ছিল ২৩ হাজার টাকা করে আর আমার অধীনে থাকা সাব এডিটরদের দেওয়া হচ্ছিল  হাজার টাকা করে বেশিরভাগ প্রতিবেদকের বেতনও এই  হাজার টাকা তারপরে এই বেতনও রাখা হয় বকেয়া ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক হিসেবে মুনীর ভাইয়ের বেতন ৩৫ হাজার টাকা তার আগে তিনি যখন সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করছিলেনতখন বেতন ছিল আরও কম সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলোমুনীর ভাইয়ের বেতন বকেয়া পড়েছে ১৫ বছরের মত সাব এডিটররিপোর্টারদের বেতন বকেয়া কারও  বছরকারও  বছরকম করে হলেও কারও  বছর সামান্য টাকা বেতনতারপর তা বকেয়াএই বাস্তবতায় Ôসুষ্ঠু এবং Ôদুর্নীতিমুক্ত ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলার ভাবনা কল্পনা মাত্র তারপরেও সংবাদের সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে দুর্র্নীতির অভিযোগ ছিল না খুব কষ্ট করে তারা Ôবাপের খেয়ে Ôমায়ের পয়সায় সেবা দিতেন সংবাদে মফস্বলে যাঁরা করেনতাঁদের তো পয়সা দেওয়া দূরে থাকতাদের কাছ থেকেই সাহায্য-সহযোগিতা (বিশেষ করে শ্রমনেওয়া হয় ভাল ভাল সাধু কথা বলে অবশ্য বিজ্ঞাপন বিভাগ থেকে তাদেরকে বিজ্ঞাপনের জন্য কমিশন দেওয়ার কথা বলে কাজ আদায় করা হলেওকমিশনের বেলায় নানা জটিলতা তৈরি করা হতো সংবাদের মফস্বল সাংবাদিকরা এলাকায় প্রতিষ্ঠিতঅনেকেই বিত্তশালী ছিলেন বলে তাঁরা  পাওনা নিয়ে উচ্চবাচ্য করতেন না তাঁরা সাংবাদিকতা করে সমাজে উচ্চ সম্মান পানএটাই ছিল তাঁদের বড় পাওয়া মফস্বল সাংবাদিকদের অবস্থার কথা আমি আমার একটি গ্রন্থে (এডিটিং এন্ড রিপোর্টিংতুলেও ধরেছি

কর্তৃপক্ষ বা মালিককে নিয়ে বড় ধরনের সমস্যা চলমান ছিল অভিযোগটা ছিল এইরকম যেপরিবার থেকে বেতনের জন্য তাঁর হাত দিয়ে টাকা পাঠানো হয়েছে মাঝ পথে তিনি আর সে টাকা অফিসে জমা দেননি ওই টাকা নিয়ে তিনি ভারতে খেলা দেখতে চলে গেছেন এদিকে বেতন না পেয়ে অফিসে যে কী করুণ দশা হতোতা কল্পনাও করা যায় না

প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ ঠিক রাখার জন্য কর্তৃপক্ষ নির্ভর করতো প্রশাসনিক বিভাগের উপর এই বিভাগের Ôনীতি নিয়ে সুনামের চেয়ে দুর্নামটাই বেশি এই বিভাগের আবার প্রতিষ্ঠানের উপর একটা খবরদারি ভাব ছিল এমনকি  বিভাগ বলা যায়ভারপ্রাপ্ত সম্পাদককেও তোয়াক্কা করে না মুনীর ভাই অনেক সময় ক্ষিপ্ত হয়ে অফিস বয়কট পর্যন্ত করেছেন কখনও ওই বিভাগের দায়িত্বশীলকে Ôচাকরি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে লজ্জাস্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন উল্টো সেখান থেকে মুখের উপর বলে দেওয়া হয়েছে, Ôআমরা আপনার চাকরি করি না

মুনীর ভাই এসব পরিস্থিতিতে ভুগেও কাজ করেছেন তিনি টেলিভিশনগুলোর টক শোতে অংশ নিয়ে নগদ যে সম্মানীটা পেতেনসেটাই ছিল তাঁর নিত্য খরচের মাধ্যম টক শোগুলোতে মানুষের জন্য অনেক নীতিবাক্য শুনিয়ে নিজে তাঁকে নীতিবাক্য বাইরে জীবন চালাতে হতো

 

---------- চলবে ----------


রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

-       আবুল হোসেন খোকন

সংবাদ নিয়ে কথা বলার এই পর্যায়ে কলাম লেখা নিয়ে কিছু বলা দরকার। সংবাদে আসার পরেই আমার কলাম লেখার পরিসমাপ্তি ঘটে। সেটা বলার জন্যই  লেখা।

কলাম লেখার শুরুটা ঘটেছিল প্রবন্ধ এবং সাহিত্য পাতার জন্য লেখার মধ্যদিয়ে। সেটা ছিল সত্তর দশকের শেষ দিক। তখন রাজশাহী থেকে বেরুতো জাতীয় দৈনিক দৈনিক বার্তা সম্পাদক ছিলেন পথিকৃৎ সাংবাদিক কামাল লোহানী। আর আমার প্রবন্ধ এবং সাহিত্য পাতার জন্য লেখায় উৎসাহ জোগাচ্ছিলেন শাহ আনিসুর রহমান। আগের কোনো লেখায় বলেছিতাঁরা আমাকে কখনও দেখেননি। দেখলে লেখা নাও ছাপাতে পারতেন। কারণ আমার বয়স। ওই ছোট্ট বয়সে এসব বড় বড় লেখা আমিই লিখছিসেটা হয়তো তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। আসলে ছোট বেলা থেকে বামপন্থী রাজনীতির তুখোর কর্মী এবং সেই সুবাদে মার্কসীয় দর্শনের উপর ব্যাপক পড়াশুনাআমাকে জ্ঞানের দিক থেকে উন্নত করেছিল। তাছাড়া ওই বয়সে সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার সময় দুই দফায় জেলেও যেতে হয়েছে (পরে আরেক দফা জেলে থাকতে হয়েছে সামরিক শাসক এরশাদের সময়) যার ফলেই ভারি ভারি লেখাগুলো লিখতে পারছিলাম। আমি দৈনিক বার্তায় প্রবন্ধ আর সাহিত্য বিষয়ে লিখতে লিখতে কলাম লেখায় অগ্রসর হই। ঠিক ওইরকম সময়েই পাবনার নামকরা শিক্ষাবিদ এবং সাংবাদিক শিবজিত নাগ সাপ্তাহিক বিবৃতির সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেই সংবাদপত্রে আমাকেও যুক্ত করেন। এরপর তিনি আমাকে কলাম লেখাসম্পাদকীয় লেখাসহ বিভিন্ন লেখায় শুধু উৎসাহিতই করেননিচাপ দিয়ে লিখতে বাধ্য করেছেন। সেগুলো ছাপা হয়েছে সাপ্তাহিক বিবৃতি ছাড়াও অনেক পত্রিকায়। তখন পত্রিকার সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। দৈনিকের চেয়ে সাপ্তাহিক সংবাদপত্র এবং সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনের সংখ্যা ছিল একটু বেশি। আমি যেগুলোতে লিখতাম সেগুলো ঢাকার।

এরপরে বিবৃতির সম্পাদক আমিও হয়েছি। আরও পরে আমার সম্পাদিতসাপ্তাহিক পাবনা বেরিয়েছেপরে বগুড়া থেকে প্রকাশিত দৈনিক উত্তরাঞ্চল- যুক্ত হয়েছি। এসব জায়গায়ও আমার কলাম ছিল অন্যতম। আশির দশকে কলাম লেখার মূল ক্ষেত্র হয়ে ওঠে রাজধানী ঢাকার দৈনিক  সাপ্তাহিকগুলো। নব্বইয়ের দশকে এসে তা আরও বিস্তৃত হয়। অবশ্য পুরো নব্বই দশক আমার কর্ম অবস্থান ছিল বগুড়া। সেখানে দৈনিক উত্তরবার্তাসাপ্তাহিক শরণীসাপ্তাহিক পূর্বালোক ছিল লেখার মূল জায়গা। এর বাইরে রাজধানী ঢাকার দৈনিক আজকের কাগজদৈনিক সংবাদদৈনিক ভোরের কাগজদৈনিক জনকণ্ঠদৈনিক সমকালসহ আরও কয়েকটি দৈনিক এবং সাপ্তাহিক রোববারসহ অনেকগুলো সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনে (এগুলোর বেশির ভাগেরই নাম মনে পড়ছে নাকারণ ম্যাগাজিনগুলো সংগ্রহেও রাখতে পারিনিনিয়মিত কলাম লিখেছি। প্রখ্যাত সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকার সম্পাদিত দৈনিক মাতৃভূমি এবং তারপরে তাঁর সম্পাদিত সাপ্তাহিক ম্যাগাজিনগুলোর নিয়মিত কলাম লেখক ছিলাম। বগুড়া ছেড়ে ঢাকায় আসার পর খুশী কবির পরিচালিত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা নিজেরা করি এবং বিশিষ্ট লেখক সাংবাদিক শাহরিয়ার কবিরের নেতৃত্বাধীন ‌‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সঙ্গেও যুক্ত ছিলাম। সেখানে থেকেও কলাম লেখার কাজগুলো চালিয়ে গেছি নিয়মিত। এই লেখালেখির কারণে তথাকথিত এক-এগারোর সময় দেশে-বিদেশে একরকম খ্যাতনামা কলাম লেখক হিসেবেও পরিচিতি এসে গিয়েছিল। কারণ ওই সময় শাসকগোষ্ঠীর দালাল শ্রেণীর লেখক ছাড়া আর কারও টিকে থাকা কঠিন ছিল। টিকতে হলে গোঁয়ারের মত লড়তে হতো। ফলে সব কাগজগুলোতে একদল সুবিধাভোগী বিশেষ শ্রেণীর লোক ছাড়া আর সবাই প্রায় লেখা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তারা জীবন-জীবিকার ভয়ে  পন্থা অবলম্বন করতে বাধ্য হন। ফলে তখন অদৃশ্য সামরিক শাসকদের কঠোর সমালোচনা করে লেখার মানুষ কমতে কমতে / জনে এসে দাঁড়িয়েছিল। এই / জনের একজন আমিও ছিলাম। তখন দেশের কাগজগুলোর মধ্যে দৈনিক আজকের কাগজদৈনিক সংবাদদৈনিক ভোরের কাগজ এবং দৈনিক জনকণ্ঠ আমাদের কলামগুলো দুঃসাহস নিয়ে ছাপতো। এসময় আমার কলামগুলো দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও প্রকাশ হতে থাকে। এসব বিদেশি অনলাইন গণমাধ্যমগুলোর অবস্থান ছিল ব্রিটেনকানাডাঅস্ট্রেলিয়াসৌদি আরবনিউইয়র্ক এবং জার্মানি। যে কলামগুলো দেশের কাগজগুলো ছাপার সাহস পাবে নাসেগুলো পাঠাতাম বিদেশে। তখন এসব কলামের প্রভাব এবং শক্তি এতোটাই প্রবল হয়ে উঠেছিল যেএক-এগারো সরকারের অস্তিত্ব ধসের মুখে চলে আসে এবং সাদা পোশাকের বিশেষ লোকেরা আমাদের হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আমার একটা লেখা ছাপার কদিন পরে তো দৈনিক আজকের কাগজ আকস্মিকভাবে বন্ধই হয়ে গেল। আমার একটা লেখারকথা বলছি এজন্য যেওই লেখাটা ছাপতে পাঠিয়ে দিয়ে উপসম্পাদকীয় পাতার দয়িত্বে থাকা সালাম সালেহ উদদীন ফোন করে বলেন‌‘এতো ভয়ঙ্কর লেখা যে লেখেনএখন আমাদেরই না ধরে নিয়ে যায়কাগজও বন্ধ করে দিতে পারে। তারপরেও ছাপা হচ্ছে আপনার লেখা। সত্যিইলেখা ছাপা হয়েছিলতার /৪দিন পরেই বন্ধ হয়ে গেল আজকের কাগজ। তবে এই লেখানাঅন্য কোন কারণে আজকের কাগজ বন্ধ হয়ে যায়তা আজও জানা হয়নি।

ভোরের কাগজেও প্রায় এরকম একটি ঘটনা ঘটে। একদিন রাত ১০টার দিকে ফোন করলেন উপসম্পাদকীয় পাতার দায়িত্বে থাকা হারুন রশীদ ভাই। বললেন‌‘আপনার লেখা মেকাপ করে ছেড়ে দেওয়ার পর তুলে নিতে হচ্ছে। আপনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বক্তব্যকে যেভাবে সমালোচনা করেছেনতা ছাপা সম্ভব নয়। আসলে উনি পেজমেকাপ করে প্রেসে পাঠানোর পর উপরের কেও চেক করতে গিয়ে বিষয়টি ধরেন এবং বিভাগীয় সম্পাদকের উপর চড়াও হন। তারপর প্রেস থেকে মেকাপ পরিবর্তন করা হয়। ঘটনা হলোআমার লেখাগুলো বেশিরভাগ কাগজগুলোই চেক করতো না। তাঁরা আমার লেখা সম্পর্কে নিশ্চিত থাকতো। তাই কোনরকম চেক না করেই বিশ্বাস বা আস্থার উপর ভর করে ছেড়ে দিতোএডিটিংয়ের প্রয়োজন হতো না। যদি এই লেখাটি এডিটিংয়ে দেওয়া হতোতাহলে আগেই হয়তো বাতিল হতো। এতো ঝামেলার দরকার হতো না।

যাই হোককলাম লেখার জন্যই আশির দশকনব্বইয়ের দশক এবং পরের দশকের একটা সময় পর্যন্ত ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছিলাম। সাংবাদিকতার জীবনে এটা ছিল আমার অনেক অনেক বড় পাওয়া। এরজন্য দেশ-বিদেশ থেকে অসংখ্য প্রশংসাচিঠি ইত্যাদি পেয়েছি। বগুড়ায় দৈনিক করতোয়ার  মতো বহুল প্রচারিত দৈনিকের পাঠকরার ওই সময় আমার কলামের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতেন। সাংবাদিক হিসেবে এমন প্রশংসা সত্যিই নিজের জন্য গর্বের ছিল। কিন্তু এরমধ্যে আবার একটা বিপরীত দিকটাও ছিল। এটা কেউ কখনও বলেন না। কিন্তু আমি বলছি। একই পেশার অনেকজনই সহকর্মীর এরকম প্রশংসা পাওয়াকে ভালভাবে নিতে পারতেন না। এটা তাঁদের প্রতিষ্ঠিত ইগোতে মারাত্মকভাবে আঘাত করতো। তাই বলছিশক্রপক্ষের শত্রæতায় দুঃখ থাকে নাকিন্তু নিজের ঘরে যখন এটা হয় তখন খুব কষ্ট পেতে হয়। এই কষ্ট থেকেও হয়তো আমাকে কলাম লেখা থেকে সরে আসায় খুব ধীরে হলেও ইন্ধন জুগিয়েছে।

আমার কলাম লেখাকে শুধু উৎসাহিত করেই যাঁরা ক্ষ্যান্ত হননিচাপ প্রয়োগ করে লিখতে বাধ্য করেছেনতাঁদের মধ্যে পাবনার প্রফেসর শিবজিত নাগপ্রয়াত সাংবাদিক আনোয়ারুল হকপ্রয়াত সাংবাদিক আবদুস সাত্তার বাসুপ্রয়াত সাংবাদিক মির্জা শামসুল ইসলামপ্রয়াত সাংবাদিক আমিরুল ইসলামবগুড়ার প্রয়াত সাংবাদিক দুর্গাদাস মুখার্জীপ্রয়াত সাংবাদিক মুহআবদুল মতীনমাহবুব উল আলম টোকনপ্রয়াত যাহেদুর রহমান যাদুজাতীয় পর্যায়ে উপমহাদেশের পথিকৃৎ সাংবাদিক প্রয়াত কামাল লোহানীপ্রয়াত সংবাদ সম্পাদক মুনীরুজ্জামানপথিকৃৎ সাংবাদিক বিভুরঞ্জন সরকারের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ।

একটা পর্যায়ে বিএনপি-জামায়াত জোট এবং এক-এগারোর সরকার থেকে নির্যাতনের মুখে পড়েছি। তখন তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা নিজস্ব তহবিল থেকে বেশ জন সাংবাদিককে আর্থিক সহায়তা করেছিলেনতারমধ্যে আমিও ছিলাম। তাঁর সেই সহায়তা তুলে দিয়েছিলেন দৈনিক যুগান্তরের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার। এটা যেমন ছিল নিজের জন্য সাংবাদিকতার স্বীকৃতিতেমন ছিল কঠিন বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ানোর বিষয়ও।

যাক সেসব। লেখার শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। বলছিলামসংবাদের আসার পর কেন বন্ধ হয়ে গেল কলাম লেখা। সেটা দিয়েই  পর্বের ইতি। সংবাদে যখন আসিনিতখন আমার কলামগুলো এক নম্বরে (অর্থাৎ সর্বপ্রথম উসম্পাদকীয় হিসেবেএবং দুই নম্বরে ছাপা হতো। এর মানে হলোআমার লেখাগুলোর মান-গুন শীর্ষে ছিল। কিন্তু যখন সংবাদের যুক্ত হলামতখন নিজেকে গুছিয়ে নিতে বেশ কতগুলো মাস সময় নিয়েছিলাম। এই সময়ে কোথাও কলাম লিখিনি। অফিসিয়ালি ইঙ্গিতও দেওয়া হয়েছিলসংবাদ ছাড়া যেন আর কোথাও না লিখি। সে কারণে সংবাদেও কলাম বা উপসম্পাদকীয় লিখিনিঅন্য কোথাও নয়। তারপর এক সময় সংবাদের জন্য লিখলাম। জমা দিলাম। ছাপার জন্য পাঠানোও হলো। তারপর দেখিছাপা হয়নি। পরে সংশ্লিষ্টজনকে প্রশ্ন করলাম। তিনি জানালেনমুনীর ভাই বাদ দিয়েছেন। মুনীর ভাইকে প্রশ্ন করলাম। তিনি স্পষ্ট করে উত্তর দিলেন না। বললেনআর কতো লিখবেনকী হবে লিখে?........ 

তাঁর এই কথার অর্থ উদ্ধার করতে পারিনি। পরে আরেকটি লেখা জমা দিলাম। সেটাও ছাপা হলো না। অথচ লেখা ছাপানোর জন্য অনুরোধ করে আমার কাছ পাঠানো অন্যের লেখা যখন জমা দিলামসেটা ঠিকই ছাপা হলো। বুঝতে পারলামআমার লেখা ছাপাতে চাওয়া হচ্ছে না। আগেই বলেছিঅনেক সময় ইগো কাজ করে। যেমন এটা দেখেছি করতোয়ার একজনের মধ্যে এবং একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি প্রধানের মধ্যে (অথচ এই একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রধান অনেক আগে থেকেই আমার অগ্রজ শ্রদ্ধাভাজনআজও তাই-) ভাবলাম সমস্যাটা সংবাদেও। যখন মুনীর ভাইয়ের কাছে ছিলাম নাদূরে থেকে লেখা জমা দিতাম-তখন লেখার কদর ছিল। আর যেই না কাছে চলে এলামতখনই ইগোর কারণ হলাম।

সেই থেকে লেখা বন্ধ। আর লিখি না। কোথাও না। আর না লিখলে হারিয়ে যেতে হয়। আমি সেই থেকে হারিয়ে গেছি।

 

----- চলবে -----

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message