শুক্রবার, ২ জুলাই, ২০২১

স্বপ্ন রাতের তারা, আশির দশকের ধারাবাহিক গল্প (পর্ব-১১)

স্বপ্ন রাতের তারা

আবুল হোসেন খোকন

 

ষোল.

শেষ দেখা-সাক্ষাতের ঘটনাগুলো ঘটলো শর্টকাট এবং দ্রæ সিনেমার রিল খুব তাড়াতাড়ি ঘোরাবার মতো দেখা হলো সেই কাকীমার সঙ্গে মীরা কাকীমা মাত্র চারটি চরিত্রের পরিবার কাকা কমিউনিস্ট স্ট্যালিনের মতো তাঁর গোঁফ কিন্তু তিনি পুরোপুরি স্ট্যালিনপন্থী নন কাকীমা কমিউনিস্ট নন তিনি উল্টো আর তাঁদের সন্তানদ্বয় মায়ের বিপরীত দীপা রাকসুর নেত্রী এখন পড়াশুনা শেষ করে এনজিওতে ঢুকেছে ঢাকায় থাকে আগে সে ছিল ছাত্র ইউনিয়নের দুর্ধর্ষ নেত্রী অঞ্জন হলো সবার ছোট বুদ্ধি কম উদ্ভট উদ্ভট স্বপ্ন দেখে যদি শিল্পী হতো খুব ভাল করতো

সবার সঙ্গে দেখা হলো, কথা হলোÑ কিন্তু আগের মতো অনেক সময় দেওয়া হলো না দিপু ওরফে খোকন নম্বর টু, এক সময় জীবন-মরণের বন্ধু ছিল এখন দূরে দূরে থাকায় সম্পর্কটা হালকা হয়ে গেছে ওদের বাড়িতে সবচেয়ে ভালবাসতো মা-টা একেবারে নিজের সন্তান দিপুরা কয়েক ভাই-বোন তারমধ্যে ছোট দুই বোন সেতু আর আঞ্জু আমার স্মৃতিতে এক ইতিহাস হয়ে আছে তখন ওরা একেবারে ছোট ছিল আঞ্জু কোন রকমে হাঁটতে পারতো, আর সেতু একটু বড় ছিল

সবাই তখন দোগাছী গ্রামে থাকতো কয়েক পুলিশ গ্রামে হানা দিয়ে আমাকে ধরে ফেলেছে রাজনীতি করতাম তো তাই পিছমোড়া করে বেঁধে কনভয়ের পেছনে বসিয়েছে যে রাস্তা দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে তার ধারেই দিপুদের বাড়ি বাড়ি-ঘরগুলো থেকে লোকজন তাকিয়ে আছে রাস্তার ধারে অনেক লোক মাথা নিচু করে সার সার দাঁড়িয়ে সবার মন খারাপ কারও চোখে পানি দৃশ্যটা সিনেমার মতো স্থিরচিত্রের মতো অসংখ্য মানুষ সারি সারি দাঁড়িয়ে, তার মাঝদিয়ে ধীরে এগিয়ে চলেছে পুলিশের কনভয় আর সমস্ত দৃশ্যকে ভেঙে চুরমার করে দিলো সেতু আর আঞ্জু ওরা মাটির ঢিলা তুলে সর্বশক্তি দিয়ে পুলিশের গাড়ির দিকে অবিরাম ছুঁড়ে মারছে আর চিৎকার করে বলছে, ‘হারামজাদারা, আমার ভাইকে নিয়ে যাচ্ছে ছেড়ে দে হারামজাদারা

সেই সেতুদের বাড়িতে যখন গেলাম, তখন রাত ১০ টার কাছাকাছি বাড়ি ভর্তি প্রচুর লোক বেড়াতে এসেছে দেখা হলো সবার সঙ্গে কিন্তু আগের দিনগুলোর মতো কথা বলার কোন সুযোগ হলো না

সোমা হলো বিচ্ছু মেয়ে গণশিল্পী সংস্থার প্রথম খুঁদে শিল্পী ফুটপাত, রাজপথ, মঞ্চ যেখানেই গানের অনুষ্ঠান হতোÑ সোমা তারমধ্যে একজন সবাই বড় বড়, আর সোমাই ডিমের মতো ছোট্ট্ একটা মেয়েÑ যে কিনা গলা ফাঁটিয়ে শোষণমুক্তির গান গাইতো ওর বাবা-মা দুজনেই একই দলের তিন শিল্পী নিয়েই সংসার ওদের বাড়িটা খুঁজে পেতে বেশ সমস্যা হয়েছে ভাড়া বাড়িতে থাকে আগে যেখানে ছিল, সেখান থেকে অন্য জায়গায় চলে এসেছে সন্ধ্যা বেলা যখন ওদের বাড়িতে গেলাম, তখন সোমা নেই ওর মা কণাদি ছিলেন সবে বাড়িতে এসেছেন সব গোছগাছ করছেন সোমার বাবা জয়ন্ত দা রাজশাহী না কোথায় যেন গেছেন ফেরেননি এখনও কণিকাদির সঙ্গে কথা বলতে বলতে সোমা এসে পড়লো কিন্তু ততোক্ষণে আমার সময় শেষ একরকম কথা না বলেই চলে আসতে হলো

গাজী-শিমু হলো দুই সাংঘাতিক শিল্পী একবারে নিজেদের উৎসর্গ করে গণসঙ্গীতের দলে নেমেছিল ওদের বাড়ি যুগিপাড়ায় আশেপাশের কয়েক বাড়ির মওলানা একদিন শিমুকে ডেকে নিয়ে বলেছিল, আর যদি রাস্তায় রাস্তায় গান করিস্Ñ তাহলে গলা টিপে মেরে ফেলবো শিমু মুখের ওপর বলে দিয়েছিল, ‘ক্ষমতা থাকে মারবেন, আপনাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা দিয়ে গেলাম গাজীকে গুন্ডারা কয়েকবার ছোরা বের করে বলেছিল, ভুড়ি ফাঁসিয়ে দেবো

সেই গাজী-শিমুদের বাড়ি গেলাম দেখা হলো কিন্তু তেমন কোন কথা-বার্তা না বলেই চলে আসতে হলো

ফেন্সি হলো গণসঙ্গীত আর নাটক দলের আরেক ক্যাডার ওর বাবা-মা অণুপরমানু পর্যন্ত নাট্যশিল্পী কতো যে নাটক করেছে ঠিক নেই ফেন্সি ছিল গণসঙ্গীত টিমের দ্বিতীয় পিচ্চি সোমার পরেই ফেন্সি সে অনেক আগের কথা এখন বড় হয়ে গেছে ওদের বাড়ি রাধানগর যখন আমি গেলাম, তখন ভাবী অর্থাৎ ফেন্সির মা বিয়ের ব্যাপার নিয়ে হইহই গল্প জুড়ে দিলো কোবাদ ভাই আর ভাবী শুধু নাটক করেন না, পাক্কা বিয়ের ঘটক কথা হতে হতে ফেন্সির বিয়ের কথা উঠলো ফুঁসে উঠলো আমাকে বললো- কাকু শোনেন, আমি বাড়ি থেকে পালাবো একেবারে আপনার ওখানে গিয়ে উঠবো দেখি কেমন করে বিয়ে দেয় আমার আপনিই বলেন, আমার কি এখন বিয়ে করা উচিত? বললাম- মোটেই না অসম্ভব এতো সকালে কক্ষণও বিয়ে হতে পারে না হাততালি দিয়ে বললো ফেন্সি- কারেক্ট, আপনার সঙ্গে থাকলে কোন চিন্তা নাই আমার আর ভয় নেই মাকে আচ্ছামত কিছু বলে দেন্ তো!- আমি হাসলাম ভাবীও হাসলো এই পর্যন্তই কথা শেষ বেড়িয়ে পড়তে হলো

কাছেই কণিকা আপার বাড়ি তাকে তুলনা করা যেতে পারে সূর্যসেন-প্রীতিলতার সঙ্গে রাজনীতি থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একজন সূর্যসৈনিক সে কণিকা আপার গোটা বাড়িটাই একই রকম মা থেকে শুরু করে সব ভাই-বোনগুলো সমাজ বিপ্লবের যোদ্ধা এখন অবশ্য সবাই থেমে গেছেন কণিকা আপা বিয়ে-টিয়ে করে ওকালতি করছেন আমি যখন গেলাম, তিনি তখন নেই অপরিচিত একজন জানালো কোর্ট থেকে ফেরেননি বাড়ির সবাই গভীর সম্পর্কের মানুষ ভিতরে ঢুকতে পারতাম, কিন্তু সময় নেই বলে দরজা থেকেই ফিরতে হলো

ছাড়া শেষ সময়ের চোখের দেখা দেখার জন্য আরও অনেক জায়গায় গেলাম এতো দ্রæ কাজগুলো করতে হলো, ঠিক মৃত্যুর মুহূর্তে মানুষের স্মৃতিতে যেমন খুব দ্রæ দেখা দিয়ে যায় অসংখ্য ঘটনার খন্ড খন্ড চিত্রÑ ঠিক সেই রকম দেখা দেওয়ার মতো করে

 

বিদায়ের এই সময়ে হঠাৎ শহরে মারপিট ছড়িয়ে পড়েছে ছোট-খাটো ব্যাপার নিয়ে প্রথমে তর্কাতর্কি, তারপর হাতাহাতি, শেষে লাঠিসোটা নিয়ে সংঘর্ষ এই সংঘর্ষ দুইজন থেকে দুই দলে, তারপর দুই পাড়ায় এবং সবশেষে দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে শুরু হয়েছে এবং তা গোটা শহরে ছড়িয়ে পড়েছে এখন আর লাঠি-সোটা বা টাঙ্গি-কিরিচ-তলোয়ার-রামদা নিয়ে সংঘর্ষ হচ্ছে না, আগ্নেয়াস্ত্রের পর্যায়ে চলে গেছে কাটা রাইফেল, পিস্তল, রিভলবার, পাইপগান, বন্দুক ইত্যাদি ব্যবহার হচ্ছে শোনা গেল স্টেনগানও নাকি কারও কারও হাতে দেখা গেছে শহরে তুমুল উত্তেজনা, সন্ত্রাস আর আতঙ্ক ছেলেরা সব ওঁৎ পেতে আছে খুনোখুনির জন্য মানুষের মধ্যে তো পশুত্ব আছেই পশুত্ব আছে বলেই ছোরা-পিস্তলের প্রতি আকর্ষণ হাঁটতে শেখেনি এমন একটা শিশুও পিস্তল ভালবাসে খেলনা পিস্তল নিয়ে খুনোখুনি খেলার খুব সখ আর বড়রা? তারা ধরনের অস্ত্র পেলে নিজেকে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন মনে করে এটা বোঝা যায় মিলিটারি বা পুলিশের দেমাগ দেখে সবই পূর্ব-পুরুষের কাছ থেকে পাওয়া তাছাড়া পশুত্ব আছে বলেই মানুষ মাংশাসী পশু যেমন মাংশ ভালবাসে, মানুষও তেমন মাংশ ভালবাসে খাবার টেবিলে মোটাসোটা মুরগীর রান পেলে কেমন চকচক করে ওঠে চোখ-মুখ!

ছেলেরা ছোটখাটো ব্যাপার থেকে মাংশাসী আর রক্তপিপাসু হয়ে উঠবেই বা না কেন? কী পেয়েছে তারা? পায়নি কোন ভবিষ্যৎ খুঁজে জানে না কেমন করে তারা এলো, কী তাদের করণীয়, ভবিষ্যতটাকে কেমন করে সাজাতে হবে অতীত না জানলে তারা দাঁড়াবে কোথায়? হতাশা তাদের গ্রাস করেছে হতাশা আর্থ-সামাজিক অবস্থা থেকে উঠে আসা হতাশা, আর উঠে আসা ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা থেকে

ব্রিটিশ আমলে ব্রিটিশ শোষণ-শাসনের বিরুদ্ধে দেশবাসী কতো না আশা নিয়ে স্বপ্ন নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নেমেছিল! কৃষক ভেবেছিল সে জমিদারের অত্যাচার থেকে রেহাই পাবে, কৃষিপণ্যের ন্যায্যমূল্য পাবে সাধারণ মানুষ ভেবেছিল জিনিস-পত্রের দাম কমবে, আয় বাড়বে সবাই ভেবেছিল দেশের সম্পদ দেশে থাকবে, দেশের উন্নতি হবে কিন্তু সবাই অবাক হয়ে ৪৭-এর পর দেখলো নতুন বোতলে পুরনো মদ! ব্রিটিশ শাসক-শোষক গিয়ে পাকিস্তানি শাসক আর শোষকের আবির্ভাব ঘটলো শুরু হলো শোষণবঞ্চনার আরেক ইতিহাস দেশবাসী হতাশ হলো তাদের স্বপ্ন-সাধ ভেঙে যেতে দেখে তারপর প্রতিবাদ হলো ৫২, ৬২, ৬৮, ৬৯ হলো ৭১-এর সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যদিয়ে আসলো কাক্সিক্ষত স্বাধীনতা, পশ্চিমা শোষণ-শাসন থেকে মুক্তি বাঙালি স্বপ্ন দেখলো সুখী জীবনের, সুন্দর সমাজ ব্যবস্থার

কিন্তু দুর্ভাগ্য দেশবাসীর! ২৪ টা বছর ধরে দুঃশাসন আর ধনীকের শোষণ মানুষকে চিবিয়ে ছোবড়া বানিয়ে ফেললো দুর্নীতিতে বিষাক্ত হয়ে গেল সমাজ তাই মানুষের হতাশা ব্যাপক গভীর এই হতাশার সামনে অন্যায়-অত্যাচার-গুন্ডামী-অস্ত্রবাজীই স্বাভাবিক তাদের কাছে এগুলো অন্যায় মনে হয় না কোন রকম বিচলিত হবার বোধ কাজ করে না সুতরাং পশুত্বই এখানে রাজত্ব কায়েম করেছে ছেলেরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে তাদের মস্তিষ্কে নিউরো ট্রান্সমিশনের হার বেড়ে গেছে

 

----------- চলবে -----------

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message