বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২১

রিপোর্টারের টুকরো স্মৃতি- চার

 

 

রিপোর্টারের

টুকরো

স্মৃতি

আবুল হোসেন খোকন

চার.

রির্পোটিং ভালই চলছিল। তবে একটা পর্যায়ে এসে এটা দ্বিখন্ডিত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ নিউজ করতে করতে সম্পাদনার দায়িত্বও চেপে বসেছিল। এরই জের ধরে পরবর্তীতে সম্পাদক কাম রিপোর্টার হয়ে বছরের পর বছর কাজ করতে হয়েছে। সে বিষয়ে পরে আসছি।

খবর সংগ্রহ করছিলাম, লিখছিলাম, তারপর তা পত্রিকায় পাঠাচ্ছিলাম। আর পত্রিকায় সেগুলোই ছাপা হচ্ছিল। তখন এরশাদের সামরিক শাসনের সময়, তাই রিপোর্ট ছাপা হওয়া মাত্র অ্যাকশন হচ্ছিল। এতেকরে নিজের মধ্যে একটা সাফল্যের ভাব ছিল। রিপোর্টের পাশাপাশি দৈনিক বার্তা ছাড়াও কিছু সাপ্তাহিকে প্রবন্ধ বা কলামও ছাপা হচ্ছিল। রকম পর্যায়ই শেষ পর্যন্ত আমাকে সম্পাদনা এবং কলাম লেখকের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল।

দৈনিক গণকণ্ঠকে ভিত্তি করে সাংবাদিকতা শুরু হলেও পত্রিকাটি বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সম্ভবত তখন ১৯৮৩ সাল। হঠাৎ করে গণকণ্ঠর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেল। আমি বেকার হয়ে গেলাম। গণকণ্ঠ আর বের হওয়ার অবস্থায় থাকলো না। স্বাভাবিকভাবেই রিপোর্টিংয়ে বাধা পড়লো। তখন দৈনিক বার্তায় সাহিত্য-সংস্কৃতি আর কলাম পাতায় লিখে সময় কাটাতে হচ্ছিল। কিন্তু রিপোর্টিংয়ের মানুষ আর কতোক্ষণই-বা রিপোর্টিং ছাড়া থাকতে পারে? বাধ্য হয়ে অন্য জায়গায় যুক্ত হওয়ার চেষ্টা শুরু করলাম।

তখন বগুড়া থেকে দৈনিক উত্তরাঞ্চল নামে একটি সংবাদপত্র বেরুতো। এটি ছিল ওই সময়ের দারুণ প্রভাবশালী দৈনিক। এর সম্পাদক ছিলেন কিংবদন্তিতুল্য বাম রাজনীতিক দুর্গাদাস মুখার্জী। এই দুর্গাদাস মুখার্জী আর মুহম্মদ আবদুল মতিন ছিলেন স্বাধীনতা পূর্ব অবিভক্ত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির সংগঠক। দুজন সমপর্যায়ের ব্যক্তিত্ব ছিলেন। পরবর্তী সময়ে দুর্গাদাস মুখার্জী দৈনিক উত্তরাঞ্চল বের করেন। এই পত্রিকার লেখাগুলো আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। সুতরাং এটাতেই যুক্ত হওয়ার চিন্তা করলাম। তখনকার বাস্তবতায় নিউজ পাঠিয়ে যোগ্যতা প্রমাণের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হতো। সুতরাং আমি লেখা পাঠানো শুরু করলাম। আর, কিছুদিন যেতে না যেতেই দেখলাম বেশ গুরুত্বসহকারে আমার নিউজ ছাপা হচ্ছে। যখন আরও কিছুদিন গেল, এবং অনেকগুলো নিউজও বড় শিরোনাম করে ছাপা হলো- তখনই সরাসরি যোগাযোগের উদ্যোগ নিলাম। সঙ্গে সঙ্গে সাড়াও পেলাম। অফিস থেকে আমাকে দেখা করতে বলা হলো। তার আগে অবশ্য আমি কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিউজ টেলিফোনে পাঠিয়েছিলাম। অনেক নিউজের সঙ্গে ছবিও থাকছিল। সেই সুবাদে টেলিফোন বিল এবং আইডি কার্ড চেয়ে দুটো আবেদনও করে রেখেছিলাম।

এরইমধ্যে পাবনার পীরপুর চরে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হলো। সময়টা ছিল ১৯৮৫ সালের ৩১ মার্চ। ঘূর্ণিঝড়ে বহু লোক মারা গিয়েছিল। গোটা পীরপুর ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। ঝড় রাতে হয়েছিল, সকাল বেলা হেলিকপ্টারে করে দেখতে এসেছিলেন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। আমরাও গিয়েছিলাম। নিউজ হিসেবে এটা ছিল সবচেয়ে বড় ঘটনা। ক্যামেরায় অনেক ছবি তুলে সেখান থেকে শহরে এসে বগুড়ায় টেলিফোন করে নিউজটি দিয়েছিলাম। সম্পাদক দুর্গাদাস মুখার্জী বললেন, শুধু নিউজ দিলে হবে না, আমি যেন কালবিলম্ব না করে ছবি নিয়ে বগুড়া চলে আসি। আমার ছবিগুলো তখনও ক্যামেরায়। প্রিন্ট করিনি। প্রিন্ট করতে যথেষ্ট সময় লাগবে। আর তখন সরাসরি বগুড়ায় না গিয়ে ছবি পৌছানোর কোন উপায়ও ছিল না। সুতরাং পীরপুর চর থেকে শহরে টেলিফোনের কাজ সেরেই বগুড়ার বাসে উঠে পড়লাম। সকালে রওনা দিয়ে দুপুর নাগাদ বগুড়া পৌছলাম। অফিস খুঁজে বের করে সম্পাদককে ক্যামেরা দিয়েদিলাম। তিনি ছবিগুলো প্রিন্ট করানোর ব্যবস্থা করলেন। 14pt;">প্রতিথযশা সাংবাদিক-রাজনীতিক দুর্গাদাস মুখার্জী অত্যন্ত কঠোর প্রকৃতির মানুষ হিসেবে পরিচিতি ছিলেন। বগুড়াসহ উত্তরাঞ্চলের প্রভাবশালীরা তাঁকে খুব ভয় করতেন। কারণ তিনি কাউকে পরোয়া করতেন না। তাঁর অফিসের কর্মী থেকে শুরু করে সবসাংবাদিকরাও তাঁকে বাঘের মতো ভয় পেতেন। পরবর্তীতে আমি যেটা বুঝেছিলাম সেটা হলো- তিনি ছিলেন বজ্র আটুনি আর ফস্কা গেড়ো মতো।

আমার ঘটনা দিয়েই বলি। আমি পাবনা প্রেসক্লাবের সভাপতি-সম্পাদক সাক্ষরিত টেলিফোন বিল দাখিল করলাম। কারণ প্রেসক্লাব থেকে করা টেলিফোন কলের বিলগুলো একসঙ্গে আসতো। পরে যার যার কল অনুযায়ী বিল তৈরি করে দিতেন সভাপতি-সম্পাদক। কিন্তু দুর্গাদাস মুখার্জী সেটা মানলেন না। তিনি বললেন, যার বিল তারটা টেলিফোন অফিস থেকেই দিতে হবে। অন্য কাওকে দিয়ে করা বিল বৈধ হবে না। তখন ভাবলাম তিনি হযতো টেলিফোন বিল, যাতায়াত বিল, ফটোর বিল- কিছুই দেবেন না। বেশ হতাশ হয়ে বসে রইলাম। তিনি উপরতলায় চলে গেলেন। বগুড়ার কাটনার পাড়ায় দ্বিতল বাড়িটিই তাঁর অফিস এবং বাড়ি। আমি যখন খুব অসহায় বোধ করে পাবনা ফিরবো কিনা ভাবছিলাম- তখন উপরতলায় ডাক পড়লো। গেলাম। দেখি টেবিলের উপর অনেক রকম খাবার সাজানো। আমাকে সঙ্গে করে তিনি খাবেন। খেলাম। কথা বলতে বলতে পেটপুড়েই খেলাম। তিনি জবরদস্তি করে নানান রকম মিষ্টিও খাওয়ালেন। শেষে বিকাল বেলা বিদায়ের সময় তিনি একটা খাম তুলে দিলেন। যাতে ছিল টেলিফোন বিল, ছবির বিলসহ যাবতীয় খরচের টাকা এবং আইডি কার্ড।

আমার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। এতো বড় মাপের মানুষের কাছ থেকে এতো আন্তরিকতা, একাত্মতা আমার কল্পনায়ও ছিল না।

ওইদিনের খবরটা ছিল পরেরদিনের সব সংবাদপত্রের ব্যানার লিড নিউজ। আমার রিপোর্টও ব্যানার লিড হয়েছিল। সঙ্গে ছিল অনেকগুলো ছবি।

দৈনিক উত্তরাঞ্চল মানুষের মাঝে এতোটাই স্থান দখল করে নিয়েছিল যে, বগুড়ার বাইরে পাবনায় এর অন্তত ৫০ কপি কাগজ চলছিল। কোনদিনও অবিক্রিত থাকেনি। ফলে চাহিদা কেবলই বেড়েছিল।

 

------------ চলবে

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message