বুধবার, ২৮ ডিসেম্বর, ২০২২

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখকদের আঞ্চলিক পান্ডুলিপিগুলো কোথায়?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখকদের

আঞ্চলিক পান্ডুলিপিগুলো কোথায়?

- আবুল হোসেন খোকন

আগে বিএনপি যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিল, তখন একটা অজানা তথ্য প্রকাশ করে দিয়েছিলেন বিএনপিরই  বুদ্ধিজীবী গিয়াস কামাল চৌধুরী। জেনারেল জিয়াউর রহমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একটি বিশেষ জায়গায় কেন শিশুপার্ক স্থাপন করেছিলেনÑ তা ওই তথ্যে উল্লেখ করা হয়। গিয়াস কামাল চৌধুরীর দেওয়া ওই তথ্যটি হলো, জিয়াউর রহমান দেখলেন ওই স্থানটিতে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করেছিল, যা ইসলাম এবং মুসলমানদের জন্য চরম লজ্জার বিষয়, চরম অবমাননাকর। তখন তিনি ১৬ ডিসেম্বরের পরাজয়ের ওই স্মৃতি মুছে ফেলার উদ্যোগ নেন। আর মুছে ফেলার জন্যই, অর্থাৎ পাকিস্তান-ইসলাম এবং মুসলমানের সম্মান রক্ষা করতেইÑ জিয়া ওই স্থানটিতে শিশুপার্ক স্থাপন করেন, যাতে ওখানে আর ১৬ ডিসেম্বরের কোন স্মৃতি গড়ে উঠতে না পারে। গিয়াস কামাল চৌধুরীর এই বক্তব্য তখন প্রায় সব জাতীয় দৈনিকে প্রকাশ হয়েছিল এবং এনিয়ে বেশ আলোড়নও উঠেছিল।

যাইহোক, ওই শিশুপার্কটি জেনারেল জিয়া থেকে বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এবং কয়েক বছর আগে পর্যন্তও বহালতবিয়তে চলে এসেছে। কিন্তু এখন আর সেটি সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সর্বোচ্চ আদালত বলে দিয়েছে, ঐতিহাসিক ওইস্থান এবং মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের জায়গাকে জাতীয় স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে। সেখানে জাতীয় আন্তর্জাতিক মানের  স্মৃতিস্তম্ভ করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় সবকাজ শেষ করতে তিনমাস সময়ও বেধে দেয়া হয়েছে। সুতরাং শিশুপার্ক স্থানান্তরের কাজ চলছে। ওই স্মৃতিস্থান হবে বিজয়ের গৌরবে নতুন করে অভিষিক্ত। শুধু তাই- নয়, বর্তমান সরকার ক্ষমতায় এসেই লক্ষ্যে পদক্ষেপ নিয়েছে এবং সারাদেশে যতো বাঙালির গৌরব এবং ঐতিহ্যের স্থান আছে, সেগুলো দখলদারদের কবল থেকে মুক্ত করে স্মৃতি সংরক্ষণাগার হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। যার ফলেই কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য, কিংবদন্তি নায়িকা সুচিত্রা সেনের পাবনার পৈত্রিক ভবনসহ সারাদেশের আরও বহু স্মৃতিস্থান এরইমধ্যে উদ্ধারের কাজ শেষ করা হয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না যে, উদ্ধার করা প্রায় সব স্মৃতিস্থানই বেদখল করে রেখেছিল মুক্তিযুদ্ধের শত্রুরা, যাদেরকে এতোকাল জেনারেল জিয়ার দল এবং মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানের দোসররা পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে এসেছে। এর বাইরে কিছু স্থান নানান স্বার্থান্বেষী চক্রও দখল করে রেখেছিল। কার্যত এই দখলবাজদেরও পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে ওই দোসররাই। এখানে গোটা ব্যাপারটি সম্পর্কে একটু ভাবলেই পরিস্কার বোঝা যায়, আমাদের ইতিহাস-ঐতিহ্য-গৌরব এবং মাথা উঁচু করে টিকে থাকার ক্ষেত্রগুলোকে ধ্বংস করতে কী-না করা হয়েছে। কী ভয়ঙ্কর কূ-পরিকল্পনায় মিশন পরিচালনা করা হয়েছে।

এই মিশনের অংশ হিসেবেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে সপবিারে হত্যা করা হয়েছে, তাঁর সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে, এরপর ক্ষমতা দখল করা হয়েছে, এবং তারপরেও মুক্তিযুদ্ধকে বাস্তবায়নকারী চার জাতীয় নেতাকে জেলখানার ভেতর পৈশাচিকভাবে হত্যা করা হয়েছে। এখানেই মিশন থেমে থাকেনি। এরপর শুরু হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের সব স্মৃতি মুছে দেয়া বিকৃত করার কাজ। ধারাবহিকভাবে করা হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের পুনর্বাসিত প্রতিষ্ঠিত করার কাজ। সব শেষে সম্পাদন করা হয়েছিল এই মুক্তিযুদ্ধের শত্রুদের ক্ষমতায় অধিষ্ঠিতকরণের কাজ, যা আমরা গত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মধ্যদিয়ে দেখেছি। ১৯৭৫ থেকে এই যে মিশনÑ তা শুধু জাতিরজনক হত্যা, মুক্তিযুদ্ধের চার পরিচালককে হত্যা, ক্ষমতা দখল এবং৭১-এর ঘাতক-দালালদের প্রতিষ্ঠাকরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এরসঙ্গে সঙ্গে পরিচালিত হয়েছে সামরিক বেসামরিক পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারীদের ওপর ব্যাপক নিধনযজ্ঞ, চালানো হয়েছে অন্তর্ঘাত। কিলিং মিশন দিয়ে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার মানুষকে। চাওয়া হয়েছে গণতান্ত্রিক-প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি এবং মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে। দলীয় নেতাদের ওপর এজন্য বার বার হামলা হয়েছে। এমনকি বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার জন্য কতোবার যে আঘাত হানা হয়েছেÑ তাও হিসেবের বিষয়। তাঁর জনসমাবেশে ২১ আগস্ট সামরিক বাহিনীর ব্যবহার করা গ্রেনেড হামলা চালিয়ে শত শত মানুষকে হতাহত করা হয়েছে।

আসলে যে ভয়ঙ্কর মিশন ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পর নামানো হয়েছিল, সেই মিশন এখনও চলছেই। বাঙালির উত্থান এবং মেরুদ- ভেঙে গুঁড়িয়ে দিতে প্রণয়ন করা হয়েছিল ওই নীলনকশা। এই নকশা অনুযায়ীই মাসের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা চালানো হয়েছে, ৩০ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। এমনকি পরাজয়ের শেষ মুহূর্তেও সুপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তানি দোসরদের দিয়ে ঘটানো হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যাকান্ড। এরপর দেশ স্বাধীন হবার পর শুরু হয়েছে মিশনের পরবর্তী অধ্যায়। এই অধ্যায়ের কুশলীব কারাÑ তা আর ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই। কারণ এটা কারোই অজানা নয়। তবে সুখের কথা হলো দীর্ঘ সময় পর হলেও বর্তমান আমলে আমরা ওই মিশনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় অবস্থান দেখতে পাচ্ছি। মিশন পরিচালনাকরীদের আইনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানোর উদ্যোগ দেখতে পাচ্ছি। সেইসঙ্গে দেখতে পাচ্ছি এদের কবল থেকে আমাদের হৃত সহায়-সম্পদ উদ্ধারের কাজ। এটি বাঙালি জাতির এক নতুন অধ্যায়Ñ তাতে কোন সন্দেহ নেই।

বলা যায় বর্তমান সরকারের অর্জনগুলোর অন্যতম হলো জাতিরজনকের স্বীকৃতি, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিভ্রান্তি দূর, পাঠ্য পুস্তকগুলোতে বিকৃত বানোয়াট তথ্য বিলোপ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস সন্নিবেশিত করা, বিভিন্ন সংস্থা প্রতিষ্ঠান থেকে চিহ্নিত অপরাধীদের অপসারণের কাজ, মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে আসীন করা এবং তাঁদের জন্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করাÑ ইত্যাদি। এছাড়া সারাদেশে গৌরব এবং ঐতিহ্যের স্থানগুলো পূনরুদ্ধার করে সেখানে স্মৃতি সংরক্ষণাগার গড়ে তোলার উদ্যোগটিও অনেক বড় দিক। সুতরাং এদিক থেকে বলা যায় সরকার অনেক কাজ করতে সক্ষম হয়েছে।

তবে কাজের এখনও অনেক বাকি রয়েছে। যেমন এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণের কাজ। এখানে উল্লেখযোগ্য যে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলা একাডেমির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংরক্ষণে একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ বা প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিলÑ যা বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার এসে বন্ধ করে দিয়েছিল। ওই উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের আঞ্চলিক ইতিহাস প্রকাশে একটা প্রকল্প ছিল। সে অনুযায়ী প্রথম পর্যায়ে যে ৭টি ইতিহাস গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। দুর্ভাগ্য, ওই গ্রন্থ প্রকাশের আগেই বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসে। তারপর থেকে আমরা আর ওই প্রকল্পের কোন খবর পাইনি। কারণ জোট সরকার এসেই প্রস্তুত করা সমস্ত পান্ডুলিপি আটকে দিয়েছিল। এরপর সেগুলো কোথায় কি করা হয়েছেÑ আমরা তা আজো জানি না। অথচ ওই পান্ডুলিপির তথ্য সংগ্রহ করতে সংগ্রাহকদের মাসের পর মাস লেগেছিল। অনেক পরিশ্রমের বিনিময়ে ওই মহা মূলবান পান্ডুলিপি প্রস্তুত করা হয়েছিল। সংগ্রহ করা হয়েছিল দূর্লভ তথ্যচিত্র, দলিল-পত্র এবং সাক্ষ্য-প্রমাণ। সবই জমা ছিল বাংলা একাডেমীর ওই প্রকল্পে।

কথা হলো ওই দলিল-পত্র, তথ্যচিত্র, সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং পান্ডুলিপিগুলো কোথায়Ñ তা আজ খুঁজে বের করা দরকার। সেগুলো বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের লোকেরা কি করেছেÑ জানা দরকার। যদি ভালভাবে ওগুলো উদ্ধার করা যায়Ñ তাহলে আবার নতুন করে তা প্রকাশের ব্যবস্থা করা উচিৎ। আর যদি ওগুলো নষ্ট করে ফেলা হয়ে থাকেÑ তাহলে সেই নষ্টকারীদেরও খুঁজে বের করা দরকার। দারকার তাদের বিচার করে দৃষ্টান্তমূলক শস্তি দেয়া। কারণ ওগুলো ধ্বংস বা নষ্ট করা মহাঅপরাধ। অপরাধীরা কোনভাবেই শাস্তি থেকে রেহাই পেতে পারে না। অতএব ব্যাপারে পদক্ষেপও হতে পারে মুক্তিযুদ্ধের অজর্নগুলোকে ফিরিয়ে আনায় গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message