শুক্রবার, ৩০ ডিসেম্বর, ২০২২

জঙ্গি অর্থায়ন



জঙ্গি অর্থায়ন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা

- আবুল হোসেন খোকন

প্রায় ১৫ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশে মৌলবাদী জঙ্গি তৈরির কাজে প্রতি বছর ব্যয় করা হচ্ছে শত-সহস্র কোটি টাকা। এরমধ্যে শুধুমাত্র দেশব্যাপী মৌলবাদীরা যে ব্যবসায়িক নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে তা থেকেই প্রতিমাসে নিট মুনাফা করছে দেড় হাজার কোটি টাকার মত। -বছর আগে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক . আবুল বারকাতের গবেষণা অনুযায়ীই তথ্য জানা গিয়েছিল। মানব উন্নয়ন গবেষণা কেন্দ্রের হিসেবে মতে, এই মুনাফার এক তৃতীয়াংশ অর্থাৎ ৫০০ কোটি টাকা ব্যয় হয় জঙ্গি তৎপরতার পেছনে, যা দিয়ে প্রতি বছর ১০ লাখ অনুসারী তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে। এই নীট মুনাফার বাইরেও জঙ্গি মৌলবাদীদের সহায়তায় বিদেশ থেকে মিলছে বিপূল পেট্রো-ডলার এবং দেশের ভেতরে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে চাঁদাবাজী দান-অনুদান থেকে। বিভিন্ন অনুসন্ধান থেকে এরইমধ্যে জানা গেছে, ২০০১ থেকে ২০০৬ পর্যন্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের পাঁচ বছরে শত শত এনজিও অনুমোদন পেয়েছে। শুধুমাত্র ওই সময়ে জামায়াত সেক্রেটারি সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদই শতাধিক এনজিওকে অনুমোদন দিয়েছিলেন। এনজিও ব্যুরোর তথ্যে দেখা গেছে, ওই পাঁচ বছরে ১১ হাজারেরও বেশি এনজিওর মাধ্যমে দেশে ৯০ হাজার কোটি টাকা এসেছে, যা ওই সময়ের বার্ষিক জাতীয় বাজেটর প্রায় সমান।

অনুসন্ধান থেকে ধারণা দেওয়া হয়, ওই অর্থের বড় অংশই ব্যয় হয়েছে জঙ্গি মৌলবাদীদের সাংগঠনিক কাজে। আরও দেখা  গেছে, এনজিওর মাধ্যমে জঙ্গিদের অর্থায়নে শীর্ষে ছিল সৌদি আরব-কুয়েত-কাতার-সংযুক্ত আরব আমিরাতের সরকারি-বেসরকারি সংস্থাসহ মধ্যপ্রচ্যের বিভিন্ন দেশ, যারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের প্রধান পৃষ্ঠপোষক বলে পরিচিত। আর বাংলাদেশে ওই অর্থ সরবরাহ হয়েছে বিভিন্ন মাধ্যম ছাড়াও বেশ কতগুলো ব্যাংকের মাধ্যমে। বিষয়টি তদন্ত করতে গিয়ে ওই সময় বিষয়টি ধরা পড়েছে এবং এরজন্য ইসলামী ব্যাংককে জরিমানাও দিতে হয়েছে। এক হিসেবে দেখা গেছে, ১৯৯৮ সালে আওয়ামী লীগের শাসনকালীন সময়ে দেশে জঙ্গি মৌলবাদী সংগঠনের সংখ্যা ছিল ৩টির মতো। পক্ষান্তরে ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত

জোট সরকারের শাসনামলে সে সংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় ১০৭টিতে। তারপর এক দশকে এই মৌলবাদী সংগঠনগুলো গ্রেনেড বোমা হামলা চালিয়েছে ৪৮ দফায় এবং এতে মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন ১৭৮ জন।

ধারণা পাওয়া গেছে, মৌলবাদীদের সহায়তাকারী এনজিওগুলো জঙ্গি নেটওয়ার্ক বিস্তারে গড়ে তুলেছে অজস্র মাদ্রাসা এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান। এইসব প্রতিষ্ঠানকে জঙ্গি মৌলবাদীদের প্রশিক্ষণ প্রদানের কাজে ব্যবহার করা হয়। এমনকি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোও নিশ্চিত হয়, ৩৩টি এনজিও সরাসারি দেশের বিভিন্ন স্থানে মাদ্রাসার উন্নয়নের নামে অর্থ জোগান দিয়েছে। আর এসব মাদ্রাসা নিষিদ্ধ ঘোষিত ৫টি সন্ত্রাসবাদী জঙ্গি সংগঠনের সাড়ে হাজার নেতা-কর্মীকে লালন-পালন করেছে।

অবস্থায় স্বাভাবিকভাবেই দেশের  যে কোন নাগরিক প্রশ্ন তুলতে পারেন যে, দেশব্যাপী এই যে শত-সহস্র এনজিও তৎপর রয়েছে তারা আসলে কি করছে, কেন করছে এবং কার স্বার্থে করছে? এরা যে তখনকরা এক বছরের জাতীয় বাজেটের প্রায় সমান ৯০ হাজার কোটি টাকা এনে খরচ করেছেÑ তা কোথায়? তাদের তৎপরতা থেকে এই দেশে দারিদ্র দূর হয়েছিল কি? সত্যি সত্যিই দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়েছিল কি? দেশে বেকারত্ব হ্রাস পেয়েছিল কি? সুশিক্ষার বিস্তৃতি ঘটেছিল কি? বৈরি পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে মানুষ স্বাবলম্বি হয়েছিল কি? দুর্যোগ-দুর্ভোগ মোকাবেলায় মানুষ বা দেশ স্বয়ংসম্পন্ন হয়েছিল কি? জনগণের জন্য প্রত্যাশিত সচেতনতা এসেছিল কি? এইসব বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর যদি ইতিবাচকই হতোÑ তাহলে উল্টো বাস্তবতা দেখা যেতো না। সুতরাং বলা যায়, কিছু এনজিওর মানবাধিকার সেবামূলক কাজ ছাড়া আসল কাজের তেমন কিছুই হয়নি। ফলে মানুষের দারিদ্রতা বেড়েছিল এবং তা পাল্লা দিয়ে চলছিল। আর বলার অপেক্ষা রাখে না, দারিদ্রের কারণে জঙ্গি তৈরির সুযোগ বা পথও খোলাশা থেকেছে। দেশে প্রয়োজনীয় আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন হয়নি বলেই অধঃপাত বেড়েছে। বেকারত্ব হ্রাস পায়নি বলেই কর্মক্ষম কর্মহীনের সংখ্যা কেবল বেড়েছে। সুশিক্ষা মেলেনি বলেই বৃহত্তর মানুষ পিছিয়ে পড়েছে। অশিক্ষা-কুশিক্ষার বিস্তৃতি থেকেছে বলেই নারীরাও জঙ্গি হয়েছে। মানুষ বৈরি পরিবেশ থেকে মুক্তি পাওয়ার পথ না পেয়ে অস্বাভাবিক পথে গেছে। বৃহত্তর জনগণ দুর্যোগ-দুর্ভোগে কেবলই সর্বস্বান্ত হয়েছে। প্রত্যাশিত সচেতনতার অভাবে জনগণকে প্রতিনিয়তই নানা ক্ষেত্রে বিপর্যস্ত হতে হয়েছে। বলা যায়, এইসব প্রধান জায়গাগুলোর উন্নয়ন না হলেও জাতীয় বাজেটের সমপরিমাণ অর্থে জঙ্গি তৈরি হয়েছে, পাশাপাশি একশ্রেণীর এনজিওর কর্মকর্তাদের বাড়ি-গাড়ি আর বিত্ত্বের প্রসার ঘটেছে, সেইসঙ্গে এনজিওর মাধ্যমে বেড়েছে তাদের ব্যবসায়িক আয়ের ক্ষেত্র। আর বাংলাদেশ কেবলই পরনির্ভর-ঋণনির্ভর এবং বিশ্ববাজারি সাম্রাজ্যবাদের পণ্যবাজারে পরিণত হয়েছে, ক্রিড়নকে পরিণত হয়েছে।

সুতরাং দিন বদলের প্রয়োজনে এই বাস্তবতা এবং অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসা যেমন জরুরি ছিল, তেমন বিষয়গুলো শিক্ষণীয়ও ছিল। এখন সেই অবস্থা থেকে অনেকটা বেরিয়ে এলেও পরিস্থিতি যে পুরো পাল্টে গেছে তা বলা যাবে না। কারণ তলে তলে চলছে নানা তৎপরতা। এটা লক্ষ্য করা যাবে, অনেক পর্যায়ে ধর্মান্ধতা এবং ধর্মের নামে পোশাক-পরিচ্ছদের ব্যবহার দেখে। ছোট-বড় শহর এবং গ্রামের দিকে তাকালে বিষয়ে ধারণা পাওয়া যেতে পারে। দেখা যাবে, আগের চাইতে ধর্মের নামে ভন্ডামি মার্কা লেবাসের দোর্দন্ড প্রতাপ। 

কিন্তু লক্ষণ ভয়াবহ বিপদের। ভেতরে ভেতরে তৈরি হচ্ছে, বা জন্ম নিচ্ছে জঙ্গিদের প্রেতাত্ত্বা। প্রক্রিয়া রুখতে না পারলে ভবিষ্যত পরিণত মোটেও শুভ হবে না। সুতরাং গোড়ায় হাত দিতে হবে। সত্যিকারভাবে জঙ্গিবাদ নির্মূলে এদের অর্থনৈতিক ভিত্তি বা নেটওয়ার্ক ভেঙে দেওয়া দরকার। যে সমস্ত বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এখানে তৎপরÑ তাদের সবার উপর সরকার এবং জনগণের জবাবদিহিতা শতভাগ নিশ্চিত করা দরকার। উন্নয়নের নামে এরা যাতে এদেশে জঙ্গিবাদ পয়দা করতে না পারে, হর্তাকর্তারা আঙ্গুল ফুড়ে কলাগাছ হতে না পারে, রাজনীতি করে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংস হুমকীর মুখে ফেলতে না পারে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে না পারে, মুক্তিযুদ্ধের মধ্যদিয়ে বহুল প্রত্যাশিত আত্মনির্ভরশীল-স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জায়গায় যেন সাম্রাজ্যবাদী আর্থ-রাজনীতির বাজার গড়ে তোলা সম্ভব না হয়Ñ তা দেখতে হবে। বিশেষ করে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাগুলো এবং জঙ্গি অর্থায়নে ব্যবহৃত জায়গাগুলোর খোল-নলচে পাল্টে দেওয়া দারকার। দরকার এসব ক্ষেত্রে সরকার এবং জনগণের পূর্ণ কর্তৃত্ব স্থাপন করার। তাহলেই কেবল দেশের মানুষকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো সম্ভব।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

Thanks for Message